১০টি ইসলামি মজার গল্প /Ten Islamic Funny Stories যা পড়লে সকলের ভালই লাগবে। গল্প থেকে আনন্দ পাওয়া যায়। সেই সাথে বহু শিক্ষা নেয়া যায়। আজকের লিখনীতে ১০টি ইসলামি মজার গল্প শোনাব। এক সাথে পাঠকদের জন্য বিভিন্ন বই খুঁজে ১০টি ইসলামি মজার গল্প উপস্থাপন করেছি। আশা করি সকলের ভালই লাগবে এই ১০টি ইসলামি মজার গল্প পড়ে।
গল্পের শিরোনাম
১. তিন লক্ষ টাকার দোয়া
২. চোর ধরার কৌশল
৩. গুরুর শিক্ষা
৪. বাদশাহীর মূল্য
৫. রুটি চোরের স্বীকারোক্তি
৬. পেট ফাঁপার চিকিৎসা
৭. মুরীদের পরীক্ষা
৮. মুরীদের জন্য কঠিন পরীক্ষা
৯. মুরীদের জন্য আরেকটি পরীক্ষা
১০. আরেক পরীক্ষা
দ্রব্যগুণের আজিব টোটকা ও যাদু শিখতে ভিজিট করুন
১০টি ইসলামি গল্প Ten Islamic Stories নিচে ধারাবাহিকভাবে দেয়া হল-
১. তিন লক্ষ টাকার দোয়া
‘আল জান্নাতু ক্বাইয়া’ন’ অর্থাৎ জান্নাত একটি ফাঁকা ময়দান। শুধুমাত্র তোমাদের আমল সেই ময়দানকে ভরে দেয়। কখনো মহল, কখনো বাগান, কখনো সুন্দরী হুর ইত্যাদি যেরূপ এবাদত সেরূপ সম্পদ সেখানে জমা হয়। হযরত মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াকুব (রঃ) এর স্বপনের একটি ঘটনা থেকে বিষয়টি বুঝতে সুবিধা হবে-
হযরত মাওলানা ছিলেন কাশফ্ওয়ালা বুযুর্গ, একজন কামেল ওলী। যারা মুহাক্কেক আলেম তারা অধিকাংশই মজযূব হয়ে থাকেন। হযরত মাওলানার মধ্যেও সেই রকম মজযূবিয়াতের শান বিদ্যমান ছিল। যখন যে-ধারণা জাগে তখন তাই করতে লেগে যান। কেন করছেন, কী প্রয়োজনে করছেন তা কেউ জানে না। শুধু মনে লেগে গেছে তাই করে যাচ্ছেন। মজযূবগণের অভ্যাসই ঐ রকম। একবার রাতে হঠাৎ কী এক ধারণা জন্মাল, তিনি তখন তিন লক্ষ টাকার জন্য দোয়া করতেন লাগলেন, ‘‘ইয়া আল্লাহ্! আমাকে তিন লক্ষ টাকা দান করুন।’’ কিন্তু কেন তিন লক্ষ চাচ্ছেন? কী প্রয়োজন টাকার? কিছুই জানেন না, শুধু মজযূবের একটা বিশেষ অবস্থার প্রতিফলন আর কি! অর্ধেক রাত অতিবাহিত হয়ে গেল দোয়া করতে করতে ‘‘হে আল্লাহ্! আমাকে তিন লক্ষ টাকা দিয়ে দিন।’’ তিন-চার ঘন্টা অতিবাহিত হল। রাত দুইটা বেজে গেল। দোয়া করার অবস্থায় বসে বসেই মাওলানার ঘুম এসে গেল। স্বপ্নে দেখেন সাদা রংয়ের একটা বিরাট অট্রালিকা। কয়েক মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত সেই সাদা মহলটি। এত সাদা যেমন দুধ সাদা হয়ে থাকে। যেন একটা মনোমুগ্ধকর ‘হোয়াইট হাউজ’ বানিয়ে রাখা হয়েছে। তার উপরে প্রতিটি দেওয়ালের ধারে ধারে মনি-মুক্তা খচিত করা হয়েছে। প্রতিটি মুক্তা সূর্যের চেয়ে অধিক উজ্জ্বল। মহলের চারিদিকে আলোর বিচ্ছূরণ, শত শত সূর্য যেন স্নিগ্ধ আলো বিকিরণ করছে। মহলটি মাওলানার খুবই পছন্দ হল। সেখানে অনেক লোক বিচরণ করছিল। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘ভাই এই মহলটি কার?’’ ওরা উত্তরে বলল, ‘‘এটা মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াকুব ছাহেবের মহল। এটা জান্নাত। জান্নাতের মধ্যে আল্লাহ্ তা’য়ালা এই মহলটি তাঁর জন্য বানিয়েছেন। মাওলানা এই কথা শুনে খুব খুশী হলেন। মহলের মধ্যে প্রবেশ করতে চাইলেন। কিন্তু দারোয়ান এসে বাধা দিল। বলল, “এখন প্রবেশের সময় হয়নি। যখন সময় হবে তখন প্রবেশ করবেন। সময় হওয়ার আগে প্রবেশ করা যাবে না।” অগত্যা মাওলানা মহলটির চারিদিকে ঘুরে ফিরে দেখতে লাগলেন। খুব ভাল লাগল। সুবহানাল্লাহ! অদ্ভুত সুন্দর এই মহল। যার বাহিরেই এত সুন্দর ভিতরে আরো কত সৌন্দর্য্যই না আছে! দেখতে দেখতে তিনি এক কোণায় গিয়ে দেখেন সেখানে দেওয়ালের একটি মোতি নাই। মোতিটা সেখান থেকে খসে পড়েছে। জায়গাটি অন্ধকার হয়ে পড়েছে। মহলটির সব জায়গায় আলোয় আলোকময় অথচ এই কোণায় একটি মোতি নাই, অন্ধকার হয়ে পড়েছে। ব্যাপার কিছু বুঝতে পারলেন না। মাওলানা লোকদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, “ভাই এখানে মোতি লাগানো হয়নি কেন? নাকি লাগানো হয়েছিল পরে খসে পড়েছে? আর খসে পড়ল-ই-বা কিভাবে? লোকেরা বলল, “মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াকূব ছাহেব আল্লাহ্ তা’য়ালার কাছে তিন লাখ টাকা চেয়েছেন। তাই আল্লাহ্ হুকুম দিয়েছেন যে, মহলের একটি মোতি খুলে পাঠিয়ে দাও। এটার দাম তিন লক্ষ টাকার চেয়েও বেশী। তাই এই মোতি খোলা হয়েছে। এই কথা শুনেই মাওলানার ঘুম ভেঙ্গে গেল। এখন তিনি অন্য রকম দোয়া শুরু করলেন, “ইয়া আল্লাহ্! আমি তিন লক্ষ টাকা চাই না, তিন হাজার টাকা চাই না, তিন শত টাকাও চাই না। যদি আমার জান্নাতের মহল সরঞ্জাম খসিয়ে দুনিয়াতে পাঠানো হয় তাহলে তো আমার জান্নাত ফাঁকা ময়দানই থেকে যাবে। আখেরাত ধ্বংস করে আমি দুনিয়ায় নিতে চাই না। সেখানেই আমি নিব।’’ এই দোয়া এখন শুরু করে দিলেন। দোয়া করতে করতে কয়েক ঘন্টা কেটে গেল। আবার ঘুম এসে গেল। দেখেন আবার সেই মহল। সেই কোণায় যখন গেলেন তখন দেখেন সেই মোতিটি সেখানে লাগানো হয়েছে। লোকেরা বলল, “মাওলানা তিন লক্ষ টাকা চেয়েছিলেন, কিন্তু পরে আবার আল্লাহর দরবারে আরজ করেছেন যে, এখন তার টাকার দরকার নাই। তাই আবার মোতিটি সেখানে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে ।’’ সুতরাং দুনিয়ার এবাদত আর যাবতীয় দুঃখ-কষ্টের সওয়াব জান্নাতে সম্পদ হয়ে প্রতিফলিত হয়ে ফাঁকা ময়দানকে ভরে দেয়। যে এখান থেকে সওয়াব না পাঠাবে তার জান্নাত ফাঁকা ময়দান হয়েই পড়ে থাকবে। জান্নাতে দুধের নহর, মধুর নহর, হুর গেলমান সব-কিছু নেয়ামত অবশ্যই আছে। কোরআন পাকে এসবের বর্ণনায় অনেক আয়াত রয়েছে। আবার হাদীস শরীফে আছে ‘আল জান্নাতু ক্বাইয়া’ন’ অর্থাৎ জান্নাত একটি ফাঁকা ময়দান। এর তাৎপর্য হল যেমন আমাদের দেশের ময়দানে লোহার খনি আছে, তামা আছে, পিতল আছে, এমন কি সোনার খনিও আছে। সকল সম্পদই আছে; কিন্তু তবু ফাঁকা ময়দান । কারণ আমরা সেগুলি উত্তোলন করি না। আবার যে দেশের লোকেরা পরিশ্রম করে সেগুলি উত্তোলন করেছে তারা সোনাও পেয়েছে, রূপাও পেয়েছে, সব সম্পদই তারা ভোগ করতে পেরেছে। সুতরাং দুনিয়াতে যারা পরিশ্রম করে এবাদত করেছে আর সওয়াবের উদ্দেশ্যে দুঃখ-কষ্ট বরণ করেছে তাদের জান্নাতের ফাঁকা ময়দানটি সম্পদে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। তাদের ময়দানে দুধের নহর, মধুর নহর, হুর-গেলমান সবই ফুটে উঠবে। (খুতবাতে হাকীমুল ইসলাম, খন্ড- ২পৃষ্ঠা- ২২৩)
২. চোর ধরার কৌশল
ইমাম আবু হানিফা (রঃ) এর যুগে এক ব্যক্তির বাড়ীতে চুরি হল। চুরি করার সময় বাড়ীর মালিক চোরকে চিনে ফেলতেই চোর ধমকি দিয়ে মালিককে বলল, “যদি এই চুরির ব্যাপারে আমার নাম কাউকে বলে দাও তবে তোমার বউ তালাক হবে- এই কথা তুমি মুখে উচ্চারণ করে বল, নচেৎ তোমাকে এখনই প্রাণে বধ করব। মালিক প্রাণের-ভয়ে বলল, “যদি আমি চুরির ব্যাপারে তোমার নাম কাউকে বলে দেই তবে আমার স্ত্রী তিন তালাক হবে।” এই কথা উচ্চারণ করিয়ে চোর পালিয়ে গেল। পরদিন সকালে চুরির শোকে মালিক দিশাহারা হয়ে পড়ল। আরো কষ্ট হলো এজন্য যে, চোরকে সামনে ঘুরে বেড়াতে দেখেও কাউকে বলতে পারছেন না। বললেই বউ তালাক হয়ে যাবে। অতঃপর ইমাম আবু হানিফা (রঃ) এর কথা তার মনে পড়ে গেল। দিশাহারা লোকটি ছুটে গেল হযরতের খেদমতে। বলল, ‘‘হুযুর এই পাড়ারই একজন লোক গত রাত্রে আমার বাড়ীতে চুরি করেছে । কিন্তু তার পরিচয় বলে দিলে আমার বউ তালাক হয়ে যাবে। সে চুরি করে যাওয়ার সময় আমাকে ভয় দেখিয়ে শর্তের তালাকের কথা উচ্চারণ করিয়ে গেছে।’’ ইমাম আবু হানিফা (রঃ) বললেন। ‘‘চিন্তার কোনো কারণ নাই । চোর ধরা যাবে। তোমার বউ তালাক হবে না।’’ ইমাম সাহেবের এই কথা শুনে সবাই অবাক হলো। চোরের পরিচয় বলে দিলে কোনো অবস্থায়ই বউ তালাক না হয়ে পারে না। পরে আলেমগণ বলাবলি করতে লাগলেন, ‘ইমাম সাহেব মাআসালায় হের-ফের করে এবার বদনামের ভাগী হবেন কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু ইমাম সাহেব বাড়ীর মালিককে ডেকে গোপনে বলে দিলেন ‘‘যারা চুরি করেনি তারা তোমার সামনে আসলে বলিও, ‘এরা চুরি করেনি।’ আর যে ব্যক্তি চুরি করেছে সে তোমার সামনে আসলে চুপ করে থাকবা।’’ অতঃপর জুমুআর নামায শেষে মসজিদের সমস্ত দরজা বন্ধ করে দেয়ার হুকুম দিয়ে তিনি এবং বাড়ীর মালিক একটামাত্র খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে থাকলেন। খোলা দরজাটি দিয়ে একটি করে লোক বের হয়ে যেতে লাগল আর ইমাম সাহেব মালিককে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, ‘‘এই লোকটি চুরি করেছে? মালিক বলে, ‘‘না এই লোক চুরি করেনি। এইভাবে যত লোক বের হয়ে যায় মালিক ঐ একই কথা বলে- ‘এই লোকটি চুরি করেনি।’ অত:পর কিছুক্ষন পর একজন লোক বের হতেই, মালিককে জিজ্ঞেস করা হল; এই লোকটি কি চুরি করেছে? মালিক তখন চুপ করে রইল। সাথে সাথেই তিনি বুঝতে পারলেন এই লোকটিই চুরি করেছে। সুতরাং তাকে পাকড়াও করার হুকুম দিলেন। এভাবে চুরির কথা বলল না তাই বউ তালাকও হল না। অথচ চোর ধরা পড়ে গেল। ইমাম আবু হানিফা (র) ফেকাহর অনেক জটিল বিষয়সমূহকে এভাবেই সহজ ও সাবলীল করে মানুষের সামনে রেখে দিয়েছেন। ফলে মানুষ তাকে ইমাম আযম বা মহান ইমাম হিসেবে অন্তরে স্থান দিয়েছে। জীবনে তিনি কোনো কথায় বা যুক্তিতে কারো কাছে পরাজিত হননি। (মাওয়ায়েজ)
৩. গুরুর শিক্ষা
হযরত সুলতান নিজামুদ্দীন (রঃ) এর যামানায় দিল্লীতে এক হিন্দু সাধু বাস করতেন। তিনি এমন এক অনুশীলন করেছিলেন যে রোগীর উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে তার রোগ দূর হয়ে যেত। একবার হযরত সুলতান নিজামুদ্দীন (রঃ) এর অসুখ হলো। তিনি মাঝে মাঝে বেহুশ হয়ে পড়তেন । হুশ হওয়ার পর খাদেমগণ একবার আরজ করলেন যে, যদি অনুমতি দান করেন তবে অমুক সাধুর কাছে হযরতের খাট কাঁধে উঠিয়ে নিয়ে যাব। সে দৃষ্টির মাধ্যমে রোগ দুর করতে পারে। হযরত বললেন, ‘সাবধান! এরূপ করিও না। তাহলে লোকদের আকীদা নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে’। কিন্তু পীরের প্রতি মুরীদের মহব্বত হয়ে থাকে এশক পর্যায়ের। হযরত যখন আবার বেহুশ হয়ে পড়লেন তখন মুরীদগণ এত পেরেশান হয়ে পড়লেন যে, হযরতের খাট উঠিয়ে সাধুর বাড়িতে হাজির করলেন এবং ভাবলেন এটা হযরতের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হওয়ার মাফ চেয়ে এর মীমাংসা করে নেয়া যাবে। সাধু দেখলেন এত বড় ব্যক্তিত্ব তার বাড়ীতে এসে উঠেছে। তিনি তৎক্ষণাৎ সব কাজ ফেলে রেখে ছুটে গেলেন হযরতের খাটের কাছে এবং দৃষ্টি দিতেই এমনভাবে রোগ দূর হয়ে গেল যে, হযরত একেবারে উঠে বসলেন। মনে হল যেন কোন রোগই ছিল না। তিনি দেখলেন যে এটা সাধুর বাড়ী। বুঝতে পারলেন, এরা আমার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। তাই কাউকে কিছু বললেন না। বরং তিনি সেই সাধুকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার মধ্যে এই শক্তি কিসের প্রভাবে সৃষ্টি হয়েছে; কোন আমলের দ্বারা তুমি এই যোগ্যতা অর্জন করেছ, বল দেখি? সাধু আরজ করলেন, ‘‘আমার মধ্যে শুধু একটি বস্তু আছে যা আমার গুরু আমাকে শিক্ষা দিয়েছিলেন। আর সেটা হলে এই যে, তিনি বলেছিলেন, ‘সব সময় নফসের বিরুদ্ধে চলিও; অর্থাৎ তোমার মন যে কাজটি করতে চায় সে কাজটি করিও না, আর যে কাজটি করতে চায় না সেই কাজটি করিও। এই একটি মাত্র অভ্যাসের দ্বারা আমার নফসের মধ্যে এমন এক শক্তি সৃষ্টি হয়েছে যার দ্বারা আমি ‘তাছাররুফ’ করে রোগ দূর করে দেই।’’ এই কথা শুনে হযরত সুলতানজী জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘আচ্ছা বল দেখি তোমার কি মুসলমান হতে মন চায়?’’
সাধু আরজ করলেন না, ‘সেটা চায়না’। হযরত বললেন, ‘‘তাহলে তোমার গুরুর শিক্ষার উপর আমল কর?’’
সাধু চিন্তায় পড়ে গেল। এদিকে হযরত উপকারের বদলে উপকারের চিন্তায় দোয়া করতে লাগলেন, ‘হে আল্লাহ্, সে আমার উপকার করেছে, আমিও তার উপকার করতে চাই। সে আমার শরীরের রোগ দূর করেছে, আমি তার রূহানী রোগ কুফুরী দূর করতে চাই। তুমি সাহায্য কর। সাধু আর ঠিক থাকতে পারলেন না, একটি ঘুর্ণিঝর খেলে গেল তার অন্তরে। সে তৎক্ষণাৎ বলে উঠল- ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।’ (আল-এফাযাতুল ইয়াউমিয়্যাহ, খন্ড-৪, প্রষ্ঠা- ৩৪৪)
৪. বাদশাহীর মূল্য
হযরত নিযামুদ্দিন আউলিয়া (র:) এর সঙ্গে সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন শত্রুতা ভাব পোষণ করতেন। কারণ হযরতের জনপ্রিয়তার দরুণ সুলতানের ধারণা জন্মেছিল যে, নিযামুদ্দিন আউলিয়া (র:) তাঁর বাদশাহী দখল করে নিতে পারেন। একদিন সুলতান অসুস্থ হয়ে পড়লেন। পেশাব বন্ধ হয়ে গেল। শাহী দরবারের জ্ঞানী-গুনী সকলে মিলে যত রকম তদবীর এবং চিকিৎসা ছিল সবই করলেন কিন্তু পেশাব আসল না। প্রাণ বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম হল। সুলতানের মা দ্রুত হযরতের খেদমতে ছুটে গেলেন। ভক্তি ও শ্রদ্ধায় বিগলিত হয়ে ক্ষমা চাইলেন এবং নিজের পুত্রের জন্য দোয়ার আবেদন করলেন। হযরত বললেন, যদি সমস্ত বাদশাহী আমার নামে লিখে দেয়া হয় এবং তার উপর যদি রাজ দরবারের সকল পরিষদের দস্তগত থাকে তাহলেই আমি সুলতানের জন্য দোয়া করতে রাজি। অন্যথায় আমি কখনো দোয়া করব না। সুলতান অসুস্থতার দরুণ বড় অসহায় হয়ে পড়েছিলেন এবং তার পেট ফুলে ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। অত:পর সুলতানের মা সমস্ত বাদশাহী লিখে দেয়া কাগজটি নিয়ে হযরতের খেদমতে পেশ করলেন। হযরত নিযামুদ্দিন আউলিয়া (র:) সেই কাগজগুলো টুকরা টুকরা করে একটি পাত্রে রেখে বললেন, এই পাত্রে তাকে পেশাব করতে বল, পেশাব এসে যাবে। সুলতানের মা তাই করলেন। পেশাব এসে গেল। সুলতান নিষ্কৃতি পেলেন। তিনি এই আমলের দ্বারা এটাই প্রমাণিত করলেন যে, তার দৃষ্টিতে সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের বাদশাহীর মূল্য পেশাবে ধরার চেয়ে অধিক মূল্যবান নয়। তাঁর এরূপ আধ্যাত্মিক কর্মকান্ডের প্রভাবে অসংখ্য অমুসলিম ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। (হুদা, মে ১৯৮৫, পৃষ্ঠা- ৬৭)
৫. রুটি চোরের স্বীকারোক্তি
এক ব্যক্তি হযরত ঈসা (আঃ) এর খেদমতে সফরে রওয়ানা হল। ঈসা (আঃ) এর সঙ্গে তিনটি রুটি ছিল। এক নদীর তীরে পৌঁছে তিনি দুইটি রুটি আহার করলেন এবং পানি পান করার জন্য নদীতে গেলেন। ফিরে এসে দেখেন অবশিষ্ট একটি রুটি নাই। তিনি সেই লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন, “রুটি কে নিয়েছে?” লোকটি বলল, “আমি জানি না।” তিনি লোকটিকে নিয়ে আবার রওয়ানা হলেন। রাস্তা চলতে চলতে যখন ক্ষুধার উদ্রেক হল তখন তিনি দূরে একটি হরিণী দেখতে পেলেন। তার সঙ্গে দুইটি বাচ্চা ছিল। তিনি একটি বাচ্চাকে ডাকলেন। বাচ্চাটি কাছে আসল। তিনি ঐ বাচ্চাটাকে জবাই করলেন এবং ভূনা করে সেই লোকটিকে নিয়ে আহার করলেন। অতঃপর বললেন, “আল্লাহর হুকুমে জিন্দা হয়ে যাও।” সঙ্গে সঙ্গে হরিণের বাচ্চা জিন্দা হয়ে চলে গেল। ঈসা (আঃ) লোকটিকে বললেন, “এই হরিণের বাচ্চা জিন্দা হয়ে যাওয়ার মোজেযা যিনি দেখালেন তাঁর কসম দিয়ে বলছি, তুমি বল রুটিটি কে নিয়েছে?” লোকটি বলল, “আমি জানি না ।” তিনি লোকটিকে নিয়ে আবার রওয়ানা হলেন। পাহাড় থেকে ঝর্ণা হয়ে নেমে আসা একটি নদী সামনে পড়ল। তিনি লোকটির হাত ধরে পানির উপর দিয়ে হেঁটে নদী পার হয়ে গেলেন। অতঃপর তিনি বললেন, “যিনি বিনা নৌকায় নদী পার হওয়ার এই মোজেযা দেখালেন তাঁর কসম দিয়ে বলছি, তুমি বল রুটি কে নিয়েছে?” লোকটি আগের মতই জওয়াব দিল, “আমি জানি না”। হযরত ঈসা (আঃ) অতঃপর এক জঙ্গলের কাছে পৌঁছে বালি জমা করতে শুরু করলেন। যখন এক বিরাট বালির স্তুপ হয়ে গেল তখন সেই স্তুপকে লক্ষ্য করে বললেন, “আল্লাহর হুকুমে সোনা হয়ে যাও।” তখনই বালির স্তুপটি সোনা হয়ে গেল। তিনি সেই সোনাকে তিন ভাগ করলেন এবং লোকটিকে লক্ষ্য করে বললেন, “এই তিন ভাগ সোনার মধ্যে এক অংশ আমার, আর এক অংশ তোমার এবং অপর অংশটি যে রুটি নিয়েছে তার।” এই কথা শুনে লোকটি তৎক্ষণাৎ বলে উঠল, “রুটি তো আমিই নিয়েছিলাম ।”
হযরত ঈসা (আঃ) বললেন, “ তাহলে তুমি সব সোনাই নিয়ে নাও”। এই বলে লোকটা থেকে পৃথক হয়ে তিনি চলে গেলেন। লোকটি তিন ভাগ সোনার সবগুলি একা পেয়ে মনের আনন্দে জঙ্গলের ধারেই অবস্থান করতে লাগল। এমন সময় দুই ব্যক্তি এসে তার সম্পদ ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য তাকে হত্যা করতে উদ্যত হল। লোকটি বলল, “লড়াই করার মধ্যে হেরে যাওয়ার ভয় সবারই আছে। তাই লড়াই না করে এসো আমরা এই সম্পদ সমান তিন ভাগ করে নেই। তোমরা একজন বাজারে গিয়ে কিছু খাবার নিয়ে এসো। ক্ষুধা নিবৃত্তি করার পর মাল ভাগ করা যাবে।” সুতরাং তার প্রস্তাবে তারা রাজি হল এবং সেই দুইজনের মধ্যে এক ব্যক্তি খাবার আনতে বাজারে গেল এবং মনে মনে ভাবল, খাবারের মধ্যে বিষ মিশিয়ে দিলে এই দুইজন মারা যাবে তখন সমস্ত সোনা আমার একার হয়ে যাবে। এই ভেবে সে খাবারের মধ্যে বিষ মিশিয়ে দিল। এদিকে এরা দুইজন পরামর্শ করল যে, এই তৃতীয় ব্যক্তিটিকে যদি মেরে ফেলা হয় তবে সমস্ত সোনা তাদের দুই জনের ভাগে বেশি করে পড়বে । তাই লোকটি বাজার থেকে ফিরে আসতেই তাকে মেরে ফেলতে হবে। সুতরাং লোকটি যখন খাবার নিয়ে ফিরে আসল তখন দুইজন মিলে তাকে হত্যা করে ফেলল এবং মনের আনন্দে খাবার খেতে লাগল। খাবার খাওয়া শেষ হতে না হতেই বিষের প্রতিক্রিয়ায় এরা দুইজনও সেখানে মারা পড়ল। সোনার তিনটি স্তুপই যেমনকার ছিল তেমনি সেখানে পড়ে রইল। কেউ পেল না। তিন জনের লাশই সোনার পাশে ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে পড়ে থাকল। ঘটনাক্রমে ঈসা (আঃ) আবার সেই রাস্তা দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। তিনি এই দৃশ্য দেখে সবাইকে ডেকে বললেন, “দেখ, সম্পদের হাকীকত এই। এর লোভ থেকে নিজেকে বাঁচাও”। (কাছাছুল আউলিয়া, খন্ড-৭, পৃষ্ঠা-১০০১)
৬. পেট ফাঁপার চিকিৎসা
পূর্বকালে বাদশাহর দরবারে আলেমদের খুব কদর ছিল। এক বাদশাহ্ দীনী বিষয় নিয়ে তার দরবারে এক আলেমের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি একটি শিশুকে নিয়ে এসে সেই আলেমের খেদমতে আরজ করল- “হুজুর আমার এই ছেলেটির পেট ফেঁপেছে, ব্যথায় খুব কষ্ট পাচ্ছে। দয়া করে কিছু করুন যেন আল্লাহ পাক তাকে আরোগ্য দান করেন।” উক্ত বুযুর্গ শিশুটির পেট লক্ষ্য করে একটি ফুঁক দিলেন এবং বললেন- যাও নিয়ে যাও। ইনশা আল্লাহ্ ভাল হয়ে যাবে।” বাদশাহ্ বিষয়টি লক্ষ্য করলেন। কিন্তু তিনি সন্তুষ্ট হলেন না। তিনি বুযুর্গকে বললেন- “হযরত! আমি আপনাকে জ্ঞানী ব্যক্তি ভেবেছিলাম। কিন্তু আপনি যা করলেন তার কোনো যুক্তি দেখি না। শিশুটি যন্ত্রণায় কাতর অথচ তার চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা না করে শুধুমাত্র একটি ফুঁক দিয়ে দিলেন। এই ফুঁ করাতে কী যায় আসে? রুগ্নদের প্রতি দয়া দেখানোই তো মহৎ ব্যক্তির লক্ষণ।” বুযুর্গ বললেন- বাদশাহ! আপনার লক্ষণ বেশী ভাল নয়। দেশের লোক আপনার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে পড়েছে। তারা আপনার বদনাম ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে। জনগনের অসন্তুষ্টি মঙ্গলজনক হয় না। বাদশাহর মুখমন্ডল কালো হয়ে একেবারে যেন নূয়ে পড়লো। বুযুর্গ বললেন- তবে দুষ্ট প্রকৃতির লোকেরাই শুধু বদনাম ছড়ায়। কারণ দুষ্টের দমনের জন্য আপনার কঠোরতায় তারা সন্তুষ্ট হতে পারে না । এতে প্রকৃতপক্ষে আপনার মর্যাদাই বৃদ্ধি পাবে। বাদশাহর মুখ এবার হাস্যোজ্জ্বল হয়ে উঠল। আনন্দে তার মুখে কথার খৈ ফুটতে লাগল। বুযুর্গ বললেন- কিন্তু দেশে দুষ্ট লোকদের সংখ্যাই অধিক। এরা বিদ্রোহ করলে আপনার ক্ষমতা রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে। একথা শুনে বাদশাহর মুখমণ্ডল লাল হয়ে উঠল। ক্রোধে তিনি ফেটে পড়লেন। আসন ছেড়ে উঠে দুই হাতের আস্তিন শুটাতে শুটাতে বললেন, কে আছে আমার সঙ্গে বিদ্রোহ করবে? আমার সৈন্য আছে, অস্ত্র আছে, বিদ্রোহ দমন করতে হয় কিভাবে তাও আমার ভাল করে জানা আছে।” বুযুর্গ বললেন- দুষ্ট লোকেরা সংখ্যায় অধিক হলেও তাদের সাহস কম থাকে। বিদ্রোহ করার মত মনোবল তাদের নাই। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আপনার মত ন্যায়পরায়ন বাদশাহ ইনশা আল্লাহ শান্তিতে থাকবেন এবং দেশেও শান্তি বিরাজ করবে। এই কথা শুনে বাদশাহ শান্ত সুবোধ ছেলের মত আসনে বসে পড়লেন। তার চেহারায় প্রশান্তির ভাব ফিরে এলো। যেন তার কিছুই হয়নি। এইবার বুযুর্গ বললেন- দেখুন বাদশাহ্ জাহাপনা! আমি আপনাকে চারটি কথা বলেছি। এর দ্বারা আপনার অবস্থা চার বার পরিবর্তন হয়েছে। প্রথম কথায় লজ্জায় অপমানে আপনার চেহারা কালো হয়ে পড়ল। দ্বিতীয় কথা দ্বারা আপনি আনন্দিত হলেন। তৃতীয় কথায় আপনার মুখমন্ডল ক্রোধে লাল হয়ে উঠল। আপনি আসন ছেড়ে উঠে ছটফট করতে লাগলনে। চতুর্থ কথায় আপনার মুখমন্ডলে শান্ত ভাব ফিরে আসল। আপনি নিশ্চিন্তে আসন গ্রহণ করলেন। “ এবার চিন্তা করে দেখুন, আমি আল্লাহ পাকের এক নগন্য বান্দা। আমার কথা যদি আপনার উপর এতটা আছর করতে পারে তবে মহান আল্লাহর কালামে কি কোনো আছর নাই? তাঁর পবিত্র বাণীর প্রভাবে কি পাহাড় চূর্ণ হয়ে যেতে পারে না? তার কথা কি মানুষের দেহের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না? রোগের উপশম হবে না? তবে কেন আপনার এই ধারণা জম্মালো যে, শিশুটির দেহের উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করা পবিত্র কোরআনের বাণী তার উপর কোনো আছর করবে না, তার রোগ উপশম হবে না”? বাদশাহ্ এইবার নিজের ভুল বুঝে লজ্জিত হলেন এবং তৌবা করলেন জীবনে আর এরূপ কথা বললেন না।
৭. মুরীদের পরীক্ষা
আগেকার বুযুর্গদের কাছে যে বা যারা মুরীদ হতে চাইত তখন বুযুর্গগণ তাদেরকে কঠিন পরীক্ষা নিয়ে তবে মুরীদ করতেন। যেমন-
এক বুযুর্গের কাছে এক ব্যক্তি মুরীদ হতে আসল। তিনি তাকে এক মারাত্মক পরীক্ষা নিলেন। তিনি বললেন, “দেখ ভাই আমি এক মুছিবতে জড়িয়ে পড়েছি। বিষয়টি গোপনীয় তাই মুরীদদের কাছে একথা বলা যাচ্ছে না। তাতে আমার প্রতি তাদের ভক্তি ও শ্রদ্ধা নষ্ট হয়ে যাবে। আর তুমি এখনও আমার মুরীদ হওনি। তাই বিষয়টি তোমার কাছে প্রকাশ করছি। এ ব্যাপারে তোমার সাহায্য দরকার। বিষয়টি হলো এই যে, আমি একটি স্ত্রীলোককে ভালবাসি। অনেক চেষ্টা-তদবীর করার পর সে ওয়াদা করেছে যে, এক রাত আমার কাছে কাটাবে। আজ সেই রাত। একটি বিশেষ সংকেত দিলেই সে বাড়ী থেকে বের হয়ে আসবে। তুমি তাকে সঙ্গে করে রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে আসতে পারলে আমিও উপকৃত হলাম আর তোমাকে মুরীদ বানিয়ে নিলাম। তার বাড়ীর ঠিকানা হল এই। বুযুর্গ ভাবলেন এখন এই লোকটি চলে যাবে আর কখনো আমার কাছে মুরীদ হতে আসবে না। মনে করবে এ আবার কেমন বুযুর্গ। এতো রীতিমত একজন চরিত্রহীন ব্যক্তি! কিন্তু লোকটি নির্দেশমত সেই স্ত্রী লোককে নিয়ে হাজির হল। বুযুর্গ ভাবলেন- রাত পোহালেই লোকটিকে আর দেখা যাবে না। কিন্তু স্ত্রী লোকটির সঙ্গে রাত্রি যাপনের পর ভোর বেলায় যখন ঘর থেকে বের হলেন তখন দেখেন লোকটি চুলা জ্বালিয়ে ঘড়ায় পানি গরম করছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “কী করছ?” লোকটি বললো, “হযরত! আপনার গোছলের পানি গরম করছি।” বুযুর্গ ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন, এত কিছু জানার পরও তুমি দেখছি এখনো যাওনি, তার কারণ কি?লোকটি বলল, হুজুর আমি আপনার সম্পর্কে সব খবরা-খবর নিয়ে তবেই মরীদ হতে এসেছি, তাই আপনাকে সন্দেহ করা আমার কাজ নয় বরং আপনার আদেশ মেনে চলাই আমার আসলকাজ। আসলে এই স্ত্রী লোকটি ছিলেন বুযুর্গের বিবি। কিন্তু লোকটিকে পরীক্ষা করতে গিয়ে এত কঠিন পদ্ধতি অনুস্বরণ করতে হয়েছে। এই কঠিন পরীক্ষা টিকে থাকা বড় মুশকিল ছিল। পরীক্ষার দ্বারা বুযুর্গের সাথে লোকটির নেসবত কায়েম হয়ে গেল। এখন মুরীদ করলে তার এছলাহ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলবে। (আল এফাযাতুল ইয়্যাউমিয়্যাহ, খন্ড-৭, পৃষ্ঠা-১৩১)
৮. মুরীদের জন্য কঠিন পরীক্ষা
এক ব্যক্তি এক বুযুর্গের কাছে “ইসমে আযম” এর সন্ধান চেয়েছিল। বুযুর্গ ব্যক্তি জানতে পারলেন যে, লোকটির মধ্যে গোপনীয়তা রক্ষা করার শক্তি নাই। না জানি কাকে কাকে শিখিয়ে বেড়াবে। বা “ইসমে আযম” শিখে কি কি কান্ড করে বেড়াবে, কে জানে? তাই তিনি মনে করেন, সে এই বস্তুর উপযুক্ত নয়। লোকটি আরয করল- “হযরত! আমি কখনো আপনার হুকুমের খেলাফ করব না। বুযুর্গের অত্যন্ত রসবোধ ছিল। তিনি বললেন, “আচ্ছা অপেক্ষা কর।” সে অপেক্ষা করল। কয়েকদিন পর তিনি দুইটি প্লেট একত্রিত করে ঢেঁকে এনে লোকটিকে দিলেন এবং বললেন, “অমুক মসজিদে এক বুযুর্গ থাকেন তাঁকে এটা দিয়ে এস। কিন্তু খবরার! তুমি রাস্তায় তা খুলে দেখবে না।” লোকটি নিয়ে চলল। রাস্তায় বিষয়টি লোকটির মনের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে দিল যে, এর মধ্যে এমন কী আছে? যদি বুযুর্গ একথা না বলতেন যে, খুলে দেখিও না, তবে মনে হয় এত উৎসাহ সৃষ্টি হত না। কিন্তু তাঁর একথা বলে দেয়াটাই সর্বনাশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। লোকটি ভাবল, এর মধ্যে এমন কী জিনিষ আছে যে, খুলে দেখতে নিষেধ করেছেন? মনে হয় কোনো খাওয়ার জিনিষ আছে। আর মনে হয় তিনি এজন্যে নিষেধ করেছেন যেন খেয়ে না ফেলি। ঠিক আছে আমি খাবো না। সুতরাং একবার খুলে দেখা উচিৎ। এই ভেবে যেই প্লেট উঁচা করল আর অমনি তার ভিতর থেকে একটি ইঁদুর লাফিয়ে পড়ল এবং দৌঁড়ে পালাল। এখন লোকটি ভারী পেরেশান হয়ে পড়ল। ইঁদুর এমন জিনিষ যে তাকে আর ধরা সম্ভব নয়। সুতরাং খালি প্লেট নিয়ে মসজিদের সেই বুযুর্গের কাছে গিয়ে হাজির হল এবং সমস্ত ঘটনা খুলে বলল। তিনি বললেন, “মনে হয় তুমি তাঁর কাছে কোনো কিছু আবেদন করেছিলে আর তিনি তোমার পরীক্ষা নিয়েছেন।” লোকটি বড় লজ্জিত হল এবং তার বুযুর্গের কাছে ফিরে আসল। শায়খ বললেন, “এখন আর তুমি আমার কাছে “ইসমে আযম” জানতে চেয়ো না। যখন তুমি সামান্য একটি জিনিষের হেফাজত করতে পারলা না তখন ইসমে আযমের মত এত বড় জিনিষের হেফাজতের আশা তোমার কাছে করা যায় না।
আল এফাযাতুল ইয়াউমিয়্যাহ্; খন্ড ৭, পৃষ্ঠা- ১৩১-৩২)
৯. মুরীদের জন্য আরেকটি পরীক্ষা
আরেকজন ব্যক্তি এসেছে ‘ইসমে আজম’ শিখতে। বুযুর্গ বললেন, ইসমে আজম অত্যন্ত শক্তিশালী একটি ইসম। এটা খারাপ ব্যক্তি বা দুনিয়াদার ব্যক্তি কিংবা লোভী ব্যক্তিকে শিখিয়ে দেয়া মোটেই সমীচীন নয়। তাছাড়া এটা এমন ব্যক্তি শিখতে পারেন যার দৈর্য্য অনেক। দৈর্য্যশীল ব্যক্তি ছাড়া এমন ইসিম শিখিয়ে দেয়া উচিত না। লোকটি বলল, ‘জনাব আমার মধ্যে উপরে বর্ণিত সকল গুণাগুন বিদ্যমান। আপনি আমাকে নির্দিধায় ইসমে আজম শিখাতে পারেন।’ বুযুর্গ বললেন, পরে আসিও। এভাবে লোকটি প্রতিদিন আসত আর বুযুর্গকে অনুরোধ জানাত। একদিন বুযুর্গ বললেন, তুমি কি এই উত্তরের পাহাড়টি চেন? হ্যাঁ চিনি, লোকটি উত্তর দিল। বুযুর্গ বললেন, তুমি এই পাহাড়ের উপরে উঠে একটু লুকিয়ে থাকবে। সারাদিন বসে থাকবে আর লক্ষ্য রাখবে নিচে কোনো ঘটনা ঘটলে আমার কাছে এসে ব্যক্ত করবে। তারপর আমি সিদ্ধান্ত দিব যে, আমি তোমাকে ইসমে আজম শিখাবো কি না। বুযুর্গের কথায় লোকটি ঐ পাহাড় বা টিলার উপর বসে থাকল। সমস্ত দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু কোনো ঘটনাতো আর ঘটছে না। লোকটি খুবই নিরাশ হয়ে গেল। হঠা দেখল একজন বৃদ্ধ লোক ঘোড়ায় চড়ে আসছে এবং ঘোড়ার উপরে বোঝাই করা কাঠ এবং কোমরে একটি টাকা তলি। লোকটি পানি পান করার জন্য ঘোড়া হতে নেমে একটি জলাশয়ে নামল আর পানি পান করে যখন ঘোড়ার কাছে গেল তখনই একটি লোক আসল এবং বৃদ্ধ লোকটির কাছ থেকে জোরপূর্বক সকল কাঠ, টাকা, কাপড়-চোগড় সবই ছিনিয়ে নিল। বৃদ্ধ লোকটি অনেক আকুতি-মিনতি করল কিন্তু কিছুই ফেরত দিল না বরং আরো প্রহার করল। তারপর ডাকাতটি পালিয়ে গেল। যে লোক টিলার উপরে বসেছিল সে মনে মনে ভাবল, যদি হুজুর আমাকে নিষেধ না করতেন তাহলে অবশ্যই আমি লোকটিকে সাহায্য করতাম। তারপর সে ফিলে এল এবং সম্পূর্ন কাহিনী বুযুর্গ ব্যক্তিকে সুন্দর করে বয়ান করল। বুযুর্গ লোকটিকে লক্ষ্য করে বললেন, যদি তুমি ইসমে আজম জানতে তাহলে কি করতে? লোকটি জবাব দিল, আমি যদি ইসমে আজম জানতাম, তাহলে ঐ দুষ্ট লোকটিকে কঠোর শাস্তি দিতাম। এমনকি তার হাত-পা ভেঙ্গে পঙ্গু করে দিতাম। তখন বুযুর্গ বললেন, তুমি ফিরে যাও কারণ আমি তোমাকে ইসমে আজম শিখাবো না। তুমি এর উপযুক্ত না। সে বলল হুজুর, আপনি যদি ঐ বৃদ্ধ লোকের কান্নাকাটি দেখতেন তাহলে আপনি এমন কথা বলতেন না বরং ঐ ডাকাতকে কড়া শাস্তি দিতেন। বুযুর্গ বললেন, হে আগন্তুক ব্যক্তি! তুমি কি জান সেই ব্যক্তি কে, যাকে ডাকাত সবকিছু ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। লোকটি বলল, না হুজুর, আমি জানি না। বুযুর্গ বললেন, এই সেই লোক যার কাছ থেকে আমি ইসমে আজম শিখেছি। এ কথা শুনে লোকটি হতবাক হয়ে রুযুর্গের দিকে তাকিয়ে রইল আর বলল, এই বৃদ্ধতো দেখছি খুবই দৈর্য্যশীল এবং সহনশীল মানুষ।
১০. আরেক পরীক্ষা
এক বুযুর্গ ছিলেন। তাঁর কাছে যে ব্যক্তি মুরীদ হতে আসত তিনি তার কাছে খাদেমকে দিয়ে খাবার পাঠিয়ে দিয়ে খাদেমকে বলতেন, “এই ব্যক্তি যখন খাবার খেয়ে সারবে তখন অবশিষ্ট খাবার আমাকে এনে দেখাবে।” খাদেম তাই করত। বেঁচে থাকা খাবার শায়খ পরীক্ষা করতেন। তিনি দেখতেন বাস্তবে তার খাবার বাঁচানোর প্রয়োজন ছিল কিনা? আর ভাত যতটুকু বেঁচেছে তরকারী সেই পরিমাণ বেঁচেছে কিনা? যতটুকু দিয়ে সেই ভাতটুকু খাওয়া চলে। যদি তা না হতো তবে তিনি বলে দিতেন, “তোমার মধ্যে শৃঙ্খলা নেই। সুতরাং তোমার মেজাজের সঙ্গে আমার মেজাজের মিল হবে না। তাই তোমাকে মুরীদ করতে পারব না।” (আল এফাযাতুল ইয়াউয়্যাহ; খন্ড ৭, পৃষ্ঠা- ১৩২)
রক্তের গ্রুপ থেকে মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য জানতে ভিজিট করুন