গল্প মানুষের চলার পথে অনুপ্রেরণা ও দিক নির্দেশনা দিতে সাহায্য করে। বিশেষ করে শ্রোতা ও পাঠককে আনন্দ দেয়। আজকের গল্পের আসরে জ্ঞানমূলক ৪টি ইসলামী গল্প বর্ণিত হল। পাঠকদের আনন্দ দেয়ার লক্ষ্যে নতুন আঙ্গিকে এই ৪টি ইসলামী গল্প। এই গল্পগুলো বিভিন্ন কিতাব থেকে নেয়া হয়েছে। এবং ৪টি ইসলামী গল্প ধারাবাহিকভাবে নিচে দেয়া হল।
এক. নওয়াব সাহেবের বাড়ী নির্মাণ
আজকাল দুনিয়া থেকে আদব-কায়দা প্রায় বিদায় নিয়েছে; তাই মানুষের মধ্যে এত পেরেশানী, বে-বরকতী এবং হতাশা। সুতরাং পরষ্পর আদব ও সম্মান অত্যন্ত জরুরি বিষয়। আল্লাহ পাকের নামেরও আদব করা উচিৎ। যেমন ‘আল্লাহ’ নামের আদব করেছিলেন টোঁকের নওয়াব। টোঁকের নওয়াব তাঁর আরামের জন্যে একটি বাড়ী নির্মাণের নির্দেশ দিলেন। নির্মাণকারী নওয়াব সাহেবের দীনদারীর প্রতি লক্ষ্য রেখে তাঁকে খুশি করার জন্যে বাড়ীর শীর্ষে ‘আল্লাহ’ শব্দটি লিখে দিল। যখন বাড়ী বানানো সম্পন্ন হল তখন নওয়াব সাহেব বাড়ীটি দেখতে আসলেন। তিনি দেখলেন আল্লাহর পবিত্র নামটি বাড়ীর শীর্ষদেশে অবস্থান করছে। তিনি বললেন, “এই বাড়ীতে বসবাস করা যাবে না। এতে বসবাস করা বেয়াদবী হবে। এই বাড়ী এখন আদব করার স্থান হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে সেই ব্যক্তিই থাকতে পারে যে সব সময় ‘আল্লাহ-আল্লাহ’ করতে পারবে। এটা এখন থেকে ইবাদতের ঘর হবে। বসবাসের জন্যে অন্য আরেকটি বাড়ী নির্মাণ করা হউক।”
অতঃপর নওয়াব সাহেব এই বাড়ীতে এসে শুধুমাত্র নামাজ পড়তেন এবং এবাদত বন্দেগী করতেন। একেই বলে আদব। আদব যার অন্তরে একবার স্থান করে নিয়েছে সে ‘আল্লাহ’ নামের যেমন আদব করে থাকে তেমনি তাঁর মখলুকের আদব করতেও ভুলে না। দুনিয়ার সুখ ও শান্তি তারাই ভোগ করে থাকে। পরকালে তাদের জন্যে রয়েছে অনাবিল সুখ। (আল-এফাযাতুল ইয়্যাউমিয়্যাহ- খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ১৭৯)
দুই. ছোরা মারার ফল
তরিকত পন্থীদের অবস্থা ঠিক বরযখবাসীদের মত হয়ে থাকে। এক এক জনের উপর এক এক অবস্থা প্রভাব বিস্তার করে থাকে। কিন্তু সবাই আল্লাহর আশেক হয়ে থাকেন। হযরত বায়েজীদ বোস্তামী (রহ) এর অবস্থা এভাবে লিখিত আছে যে, তিনি আল্লাহ পাকের শোকর আদায় করতে গিয়ে এত প্রভাবিত হয়ে পড়তেন যে, তিনি তার অজান্তেই বলে উঠতেন- “পবিত্রতা আমার, কত মহান আমার মর্যাদা!” মুরীদগণ একবার আরজ করলেন, “হযরত, আপনি এরূপ আপত্তিকর কথা বলে থাকেন।” তিনি বললেন, “এরূপ বলা খুব খারাপ, (যেহেতু মুরতাদের শাস্তি প্রাণদণ্ড) তাই আবার যদি আমি এরূপ কথা বলি তবে ছোরা মেরে আমাকে প্রাণে শেষ করে দিও”। এরপর আল্লাহর আশেক আবার সেই অবস্থার শিকার হলেন এবং বলে উঠলেন। “পবিত্রতা আমার, কত মহান আমার মর্যাদা!” মুরীদগণ পূর্বনির্দেশ মত চারিদিক থেকে ছোরা মারতে লাগলেন। কিন্তু একি? ছোরার আঘাত সব ফিরে এসে নিজেদের গায়েই লাগতে লাগল। বুযুর্গের গায়ে একটি আঘাতও লাগল না। নিজেরাই সব আহত হয়ে পড়ল। বুযুর্গ যখন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসলেন তখন মুরীদগণকে আহত দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “একি অবস্থা তোমাদের? মুরীদগণ কাঁদতে কাঁদতে আরজ করলেন, “হযরত! একি কৌশল বলে দিয়েছেন আমাদেরকে? আমরা যতটি আঘাত করেছি ততটি আঘাত ফিরে এসে আমাদের গায়েই লেগেছে। আপনার কিছুই হয়নি।” তিনি বললেন, তাহলে, “তাহলে বুঝা গেল সেই কথাটি আমি বলি নাই। যদি আমি বলতাম তবে নিশ্চয় আমার উপর শাস্তি কার্যকর হত। বলা যার অধিকার, তিনিই বলে থাকেন।” যেমন: হযরত মুসা (আঃ) যখন তুর পাহাড়ে হাজির হলেন তখন তুর পাহাড়ের বৃক্ষ থেকে আওয়াজ আসল; “নিশ্চয়ই আমি আল্লাহ”। সুতরাং আল্লাহ পাকের কথা প্রকাশের যোগ্যস্থল যদি বৃক্ষ হতে পারে তবে মানুষ যদি তাঁর কথা প্রকাশের স্থল হয় তবে আশ্চর্য হবার কিছুই নাই। (আল-এফাযাতুল ইয়্যাউমিয়্যাহ- খন্ড ৫, পৃষ্ঠা- ৩১৬)
তিন. বিনা পরিশ্রমের ব্যবসা
এক বুযুর্গের একটি ঘটনা আছে। এক ব্যক্তি তাঁকে প্রায়ই গালি দিত। যতবার গালি দিত বুযুর্গ ততবার তার বাড়ীতে কিছু টাকা পাঠিয়ে দিতেন। একদিন লোকটি ভাবল তিনি তো আমার উপকারই করছেন সুতরাং তাঁকে গালি দেয়া উচিৎ নয় । এই ভেবে সে গালি দেয়া বন্ধ করে দিল। সেই দিন থেকে বুযুর্গও তাকে টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিলেন। লোকটি এর কারণ জিজ্ঞেস করলে, “বুযুর্গ বললেন, “ভাই, ব্যবসায়ের তো এটাই নিয়ম। দিতে হবে এবং নিতে হবে। তুমি এতদিন আমাকে মাল দিয়েছো, আমি তার বদলে তোমাকে টাকা দিয়েছি। এখন তুমি মাল দেয়া বন্ধ করে দিয়েছো তাই আমিও দেয়া বন্ধ করে দিয়েছি।” লোকটি বললো, কৈ, আমি তো কখনো আপনাকে কোন কিছু দিতাম না!’ বুযুর্গ বললেন, ‘তুমি যতদিন আমাকে গালি দিয়েছো ততদিন তোমার ইবাদতের সওয়াব আমি পেতাম। বিনা পরিশ্রমে আমার অনেক সওয়াব জমা হতো। এখন তুমি গালি দেয়া বন্ধ করে দিয়েছ ফলে আমার আর সেই উপকার হয় না। তাই আমিও তোমার উপকার করা বন্ধ করে দিয়েছি।’ (আল এফাযাতুল ইয়াউমিয়্যাহ্- খন্ড ৪, পৃষ্ঠা- ১৮৬)
Neobux হতে একদম ফ্রি দৈনিক ২ ডলার ইনকাম করার পদ্ধতি জানতে ভিজিট করুন
চার. দরবেশ ও বাঘ
নির্জন কক্ষে এক দরবেশ বাস করতেন। সেই কক্ষে এক ইঁদুর এসে বাচ্চা প্রসব করল। পরে দরবেশকে দেখতে পেয়ে সব কয়টি পালিয়ে গেল। কিন্তু একটি ইঁদুরের বাচ্চা রয়ে গেল। বাচ্চার প্রতি বুযুর্গের দয়া হল। তিনি বাচ্চাটিকে দুধ ইত্যাদি পান করাতে লাগলেন। একদিন দেখলেন বাচ্চাটি মন ভার করে বসে আছে। তিনি তার দুঃখের কারণ জিজ্ঞেস করলেন। বাচ্চা বলল “আজ একটা বিরাট ইঁদুর আমাকে ধাওয়া করেছিল, আজ কোন রকমে প্রাণ বাঁচিয়েছি; কিন্তু একদিন না একদিন সে আমার উপর জয়ী হবে এবং আমার প্রাণ বধ করবে। তাই আমার দুঃখ। বুযুর্গ বললেন, “তাহলে আমি এখন তোর জন্যে কী করতে পারি?” সে বলল, আমাকে বিড়াল বানিয়ে দিন।” বুযুর্গ তখন আল্লাহ পাকের দরবারে দোয়া করলেন এবং তার শরীরে হাত বুলালেন সঙ্গে সঙ্গে সে একটি বিড়ালে পরিণত হয়ে গেল। কয়েকদিন পর দরবেশ দেখলেন-
বিড়ালটি বিমর্ষ মনে বসে আছে। তিনি আবার তার দুঃখের কারণ জিজ্ঞেস করলেন। বিড়াল বলল, “আজ মহল্লার গলিতে গিয়েছিলাম। এক কুকুর আমাকে তাড়া করেছিল। বড় কষ্ট করে প্রাণ বাঁচিয়ে এসেছি। কিন্তু এভাবে কতদিন প্রাণ বাঁচাতে পারব; তাই আমি চিন্তিত।” দরবেশ বললেন “তাহলে তুই এখন কী চাস?” বিড়াল বলল “আমাকে কুকুর বানিয়ে দিন।” বুযুর্গ আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন এবং বিড়ালের গায়ে হাত বুলালেন অমনি বিড়াল কুকুর হয়ে গেল। পাঁচ সাত দিন পর দেখলেন কুকুরটি বিষন্ন মনে বসে আছে। তিনি কারণ জিজ্ঞেস করলেন। কুকুর বলল, “আজ আমি জঙ্গলে গিয়েছিলাম সেখানে একটি নেকড়ে আমার উপর হামলা করেছিল।” বুযুর্গ বললেন, “তাহলে তুই এখন কী চাস?” সে বলল, “আমাকে নেকড়ে বানিয়ে দিন ।” বুযুর্গ দোয়া করে তার উপরে হাত বুলালেন। আর অমনি কুকুরটি নেকড়ে হয়ে গেল।
কয়েক দিন পর বুযুর্গ দেখলেন আবার সে মন খারাপ করে বসে আছে। বুযুর্গ জিজ্ঞেস করলেন, “মন খারাপ হওয়ার কারণ কী?” সে বলল, “আমি জঙ্গলে গিয়েছিলাম সেখানে একটি বাঘ আমাকে ফেড়ে খাওয়ার জন্যে তাড়া করেছিল।” বুযুর্গ বললেন, “এখন তবে তুই কী চাস?” সে বলল “আমাকে বাঘ বানিয়ে দিন। দরবেশ আল্লাহর দরবারে দোয়া করে তার গায়ে হাত বুলালেন তখন সে একটি বাঘ হয়ে গেল।
বাঘ হয়ে সে মনের আনন্দে জঙ্গলে গেল। জঙ্গলে যেতেই আগের সেই বাঘটি তাকে দেখে বলে উঠল “আরে বহুরূপী! খুব রূপ বদলিয়েছিছ বটে, কিন্তু তোর মধ্যে আর আমার মধ্যে এখনও অনেক পার্থক্য রয়েছে। তুই হলে মানুষের তৈরি বাঘ, আর আমি হলাম আল্লাহর তৈরি বাঘ। (দরবেশের তাছাররুফের মধ্যেমে তৈরি বাঘ) আর আল্লাহর তৈরি আসল বাঘের ক্ষমতা এখনই পরীক্ষা হবে। হাকিকত এখনই খুলে যাবে দাঁড়া!” এই কথা শুনে সে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “তাহলে আমার প্রাণে বাঁচার কি কোন পথ নাই?” বাঘ বলল, “একটি মাত্র পথ আছে। আগে তুই তাকে খতম করে আয় যে খোদার উপর খোদকারী করেছে, তোকে ইঁদুর থেকে বাঘ বানিয়েছে। আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে যে হস্তক্ষেপ করেছে তাকে খতম করলেই তোকে ছাড়ব।” এ কথা শুনে বাঘ চলল। জঙ্গল থেকে দরবেশের কামরায় এসে সে উপস্থিত হল। বুযুর্গ দেখলেন বাঘটি নখ বের করে থাবা প্রস্তত করে সামনে এসে ঘড় ঘড় করছে। তিনি বললেন, “আজ তোর এ কি অবস্থা?” সে বলল, আজ আমি তুকে খাবো ।” বুযুর্গ বললেন, “আমার আগের সকল দয়া এবং উপকারের কথা কি তুই ভুলে গেছিস?” সে বলল, “ধেৎ তোর উপকার! এখন আমার জান যায়, উপকারের কথা ভেবে জান হারাতে পারি না। সেই বাঘের সঙ্গে আবার দেখা হয়েছে। সে হলো আসল বাঘ । আর আমি যে ইঁদুর থেকে বাঘের রূপ ধরেছি তা সে জানতে পেরেছে। আমাকে বলেছে, “আল্লাহর সৃষ্টিতে যে হস্তক্ষেপ করে তোকে ইঁদুর থেকে বাঘ বানিয়েছে তাকে খতম করে আয় না হলে তোর রক্ষা নাই।” বুযুর্গ বললেন, “ও আচ্ছা এই কথা? ঠিক আছে তুই বস, স্থির হও। তোর জান রক্ষা হবে। আমি ব্যবস্থা করছি।” তখন এই বাঘ স্থির হয়ে বসল। বুযুর্গ সুযোগ পেয়ে দোয়া করলেন এবং তার গায়ে হাত বুলালেন। অমনি বাঘ আবার ইঁদুর হয়ে গেল। সকল বিশৃঙ্খলা দূর হয়ে আবার শান্তি ফিরে আসল। (আল-এফাযাতুল ইয়াউমিয়্যাহ্- খন্ড ৫, পৃষ্ঠা- ১৯৮)