বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের পূর্বে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস জানা আবশ্যক। প্রায় ১ হাজার বছরের পূর্ব থেকেই চর্চা হয়ে আসছে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস। বিভিন্ন চড়াই উতরায়ের মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বাঙ্গালিদের মাঝে এসেছে। কাজেই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে আজকের এই দীর্ঘ আলোচনা।
ভূমিকা
বাংলা সাহিত্যে ভাল মার্কস পেতে চাইলে অবশ্যই সাহিত্যের খুঁটিনাটি বিষয় ভালভাবে পড়তে হবে। এ ব্যাপারে যে কথাটি না বললেই নয় তা হল বাংলা সাহিত্য ও ব্যাকরণ একটু জটিল বিষয়। একটি ছোট্ট উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে। বাংলা সাহিত্যের তিনজন লেখক তাঁদের নাম লিখতেন এভাবে- মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, শহীদুল্লা কায়সার, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। এখানে শহীদুল্লাহ শব্দটিকে তিনভাবে লেখা হয়েছে। একটু সচেতনভাবে না পড়লে এই বানান গুলোতে ভুল হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভবনা বিরাজমান। এরকম বাংলায় এমন অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় আছে যা অনেক জটিল। কোনো শিক্ষার্থী যদি উচ্চ নম্বর পেতে চান তাহলে সঠিক তথ্যটি তাকে ভাল করেই জানতে হবে। তাই বাংলা পড়ার ক্ষেত্রে বা গ্রন্থ কেনার ক্ষেত্রে আপনাকে হতে হবে আরো সতর্ক। আমি অনেক খেটেখুঁটে বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো অতি যত্নসহকারে আপনাদের কাছে উপস্থাপন করেছি যাতে আপনারা উপকৃত হতে পারেন।
বাংলা সাহিত্যের যুগবিভাগ
আজ হতে হাজার বছরেরও বেশিকাল আগে শুরু হয়েছিল বাংলা সাহিত্যের পথচলা। এই দীর্ঘ সময় সাহিত্যের গতি ও বৈশিষ্ট্য সমানতালে অগ্রসর হয়নি, হওয়ার কথাও নয়। নদী যেমন তার উৎস থেকে যাত্রা শুরু করে নানাভাবে গতি পরির্বতন করে তেমনি বাংলা সাহিত্য জন্মলগ্ন থেকে আধুনিককাল পর্যন্ত নানা পরির্বতনের মধ্য দিয়ে সামনে এগিয়ে চলেছে। ইতিহাস পাঠের সুবিধার্থে বাংলা সাহিত্যের এই যুগকে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। যুগগুলো হচ্ছে-(ক) প্রাচীন যুগ, (খ) মধ্যযুগ ও (গ) আধুনিক যুগ। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস পাঠে যুগবিভাগ জানা প্রয়োজন।
প্রাচীন যুগ
ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, এ যুগের সময়সীমা ৯৫০-১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। যুগ সম্পর্কিত এই অভিমত দীনেশচন্দ্র সেন, সুকুমার সেন, গোপাল হালদার, মুহাম্মদ এনামুল হক প্রমুখ সমর্থন করেছেন। ড. মুহম্মদ শহীদু্ল্লাহর মতে, প্রাচীন যুগের সময়সীমা ৬৫০-১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। তিনি এই মত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন বটে, কিন্ত প্রামাণিক তথ্য যথেষ্ট মেলেনি। এর প্রধান সমস্যা হলো, প্রাচীন গ্রন্থ চর্যা’র কোনো কবিই এতো প্রাচীন ছিলেন না। বাংলা সাহিত্যের নিদর্শন চর্যাপদ রচিত হয় এ যুগে।
চর্যাপদ
বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগের একমাত্র নিদর্শনের নাম চর্যাপদ বা চর্যাচর্যবিনিশ্চয় বা চর্যাগীতিকোষ বা চর্যাগীতি। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবারের রয়েল লাইব্রেরী থেকে ১৯০৭ সালে এটি আবিষ্কার করেন। ১৯১৬ সালে (১৩২৩ বঙ্গাব্দ) কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে চর্যাপদ আধুনিক লিপিতে প্রকাশিত হয়। এর সম্পাদনা করেন মহা মহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। এর রচয়িতা বৌদ্ধ সহজিয়াগণ। চর্যাপদের বিষয়বস্তু বৌদ্ধ ধর্মের সাধন ভজনের তত্ত্ব। এটি একটি গানের সংকলন। চর্যাপদের সংখ্যা নিয়ে মতান্তর আছে। সুকুমার সেনের হিসেবে ৫১টি। মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে ৫০টি। চর্যাপদ ছিন্নাবস্থায় পাওয়া যাওয়ায় এই মতান্তরের সৃষ্টি। উদ্ধারকৃত পদের সংখ্যা ৪৬টি। চর্যাপদের কবির সংখ্যা নিয়েও মতভেদ আছে। সুকুমার সেনের মতে ২৪ জন। মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে ২৩ জন। সে বিচারে এক কথায় বলা চলে, চর্যাপদের কবির সংখ্যা ২৪ জন মতান্তরে ২৩ জন। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পদ রচনা করেন কাহৃপা। তার অন্য নাম কৃষ্ণাচার্য। চর্যাপদের প্রধান কবি কাহৃপা ১৩টি পদ রচনা করেন। ১২টি পদ পাওয়া গেছে। আর ২য় সর্বোচ্চ পদ লিখেন কবি ভুসুকুপা (৮টি)। চর্যাপদে ২৪, ২৫, ও ৪৮তম পদ পাওয়া যায়নি। আর ২৩নং পদটি খন্ডিত আকারে পাওয়া গেছে। চর্যার পদগুলো সন্ধ্যা বা সান্ধ্য ভাষায় রচিত। চর্যাপদের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন কবি শবরপা। চর্যাপদ যখন প্রথম প্রকাশিত হয় তখন এর নাম ছিলো ‘হাজার বছরের পুরাণ বাংলা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা।’ এটির বর্তমান বয়স প্রায় এক হাজার বছর।
অন্ধকারযুগ
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ১২০১ সাল থেকে ১৩৫০ সাল পর্যন্ত সময় অন্ধকার যুগ হিসেবে পরিচিত। এই সময়ে বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কোনো নিদর্শন পাওয়া যায়নি।
মধ্যযুগ
মধ্যযুগের সময়সীমা ১২০১-১৮০০। অন্ধকার যুগও মধ্যযুগের অন্তর্ভূক্ত।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন
মধ্যযুগে রচিত বাংলা ভায়ার প্রথম কাব্যগ্রন্থ এটি। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে (১৩১৬ বঙ্গাব্দ) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং পুঁথিশালার অধ্যক্ষ বসন্তরঞ্জন রায় পশ্চিম বঙ্গের বাঁকড়া জেলার বনবিষ্ণুপরের কাছে কাকিল্যা গ্রামের এক গৃহস্থের গোয়ালঘর থেকে এটি আবিষ্কার করেন। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে(১৩২৩ বঙ্গাব্দ) বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে বসন্তরঞ্জন রায়ের সম্পাদনায় পুঁথিটি “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন” নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। পুঁথিটির প্রথম দু’টি পাতা এবং শেষ পৃষ্ঠা পাওয়া যায়নি বলে এর নাম ও কবির নাম স্পষ্ঠ করে জানা যায়নি। কবির ভনিতায় চণ্ডীদাস, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে বড়ু চণ্ডীদাস পাওয়া যাওয়ায় এই গ্রন্থের কবি হিসেবে বড়ুচণ্ডীদাসকে গ্রহণ করা হয়েছে। এ গ্রন্থের প্রধান চরিত্রগুলো হচ্ছে- কৃষ্ণ, রাধা, বড়াই। এ কাব্যটি ১৩ খন্ডে রচিত।
মঙ্গলকাব্য
মঙ্গলকাব্য হচ্ছে মধ্যযুগের উপন্যাস। মানুষের বিশ্বাস মতে, যে কাব্য রচনা, পাঠ ও শ্রবণ করলে নিজের, প্রতিবেশীর ও সমাজের মঙ্গল হয় তা-ই মঙ্গলকাব্য। দেবতাদের কাছে মঙ্গল কামনা করে এ কাব্যগুলো রচিত হয়েছে। এ কাব্য ধারার সূত্রপাত হয় পঞ্চাদশ শতকে আর সর্বাধিক প্রসার ঘটে ষোড়শ শতকে। একটি সম্পূর্ণ মঙ্গলকাব্যে সাধারণত ৫টি অংশ থেকে। এ কাব্যে ৬২ জন কবির সন্ধান পাওয়া যায়। মঙ্গল কাব্যে প্রধান শাখা ৩টি- মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল।
মনসামঙ্গল কাব্য
মঙ্গলকাব্যের প্রাচীনতম ধারা এটি। পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশে এর প্রসার ছিল। মনসামঙ্গল কাব্যের আদি কবি কানাহরি দত্ত। এ ধারার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কবি হলেন- বিজয়গুপ্ত, বিপ্রদাস পিপিলাই, দ্বিজ বংশীদাস, কেতকা দাস, ক্ষেমানন্দ প্রমুখ। মনসামঙ্গল কাব্যগুলোকে পদ্মপুরাণ নামে অভিহিত করা হয়। মনসামঙ্গলের বিখ্যাত বাইশ জন কবিকে ‘বাইশা’ বলে।
চণ্ডীমঙ্গল কাব্য
চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের আদি কবি মানিক দত্ত। এ ধারার প্রধান কবির নাম মুকুন্দরাম চক্রবর্তী। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের প্রধান চরিত্রগুলোর নাম- কালকেতু, ফুল্লরা, ধনপতি, ভাড়ু দত্ত, মুরারী শীল প্রমুখ।
অন্নদামঙ্গল কাব্য
অন্নদামঙ্গল ধারার প্রধান কবি ভারতচন্দ্র রায়। নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাঁকে উপাধি দিয়েছিলেন ‘রায়গুণাকর’। অন্নদামঙ্গল কাব্যের উল্লেখযোগ্য চরিত্র- মানসিংহ, ভবানন্দ, বিদ্যা, সুন্দর, মালিনী প্রমুখ। অন্নদামঙ্গল কাব্য ৩ খন্ডে বিভক্ত। শিবনারায়ন, কালিকামঙ্গল, মানসিংহ- ভবান্দ খন্ড। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যের বিখ্যাত কিছু লাইন-
“মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন’
‘নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়’ ।
‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’।
বৈষ্ণব সাহিত্য
চণ্ডীদাসকে বাংলা ভাষার প্রথম মানবতাবাদী কবি বলা হয়। তার রচনার বিখ্যাত দুটি লাইন- ‘শুনহ মানুষ ভাই/সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’। মধ্যযুগের বাংলা কাব্যে অন্তত চারজন চণ্ডীদাসের কবিতা পাওয়া যায়। এরা হলেন- বডু চণ্ডীদাস, দ্বিজ চণ্ডীদাস, দীন চণ্ডীদাস, চণ্ডীদাস। এই চারটি নামের মধ্যে শেষ তিনটি নাম একজনের নাকি তাঁরা পৃথক কবি তা আজো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এ সমস্যাকে চণ্ডীদাস সমস্যা বলে।
বিদ্যাপতি
বিদ্যাপতি বাংলা ভাষার একটিও কবিতা লিখেননি, তবুও তিনি বাংলা ভাষার কবি। বিদ্যাপতি লিখেছেন ব্রজবুলি নামক একটি বানানো ভাষায়। রাজা শিবসিংহ তাঁকে ‘কবিকন্ঠহার’ উপাধিতে ভূষিত করেন। বিদ্যাপতির দু’টি বিখ্যাত লাইন- এ ভরা বাদর/মাহ ভাদর/শূন্য মন্দির মোর।
জ্ঞানদাস: তিনি চৈতন্যোত্তর বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি। মাথুর ও মুরলীশিফা তাঁর রচিত দু’টি বৈষ্ণব গীতিকাব্য। বাংলা ও ব্রজবুলি ভাষায়, রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক প্রায় ২০০ পদ লেখেন তিনি। তাঁর একটি বিখ্যাত পদের কিছু অংশ-
“সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু
অনলে পুড়িয়া গেল।
অমিয়-সাগরে সিনান করিতে
সকলি গরল ভেল”
গোবিন্দদাস
বৈষ্ণব পদকর্তা তিনি। চৈতন্যোত্তরকালে খ্যাতি অর্জনকারী কবিদের একজন তিনি। তাঁর নামে প্রায় সাড়ে চারশত বৈষ্ণব পদ পাওয়া যায়। তাঁর কাব্যগুরু ছিলেন- মিথিলার কবি বিদ্যাপতি। তাঁর রচিত একটি নাটকের নাম সঙ্গীত সাধক। কবীন্দ্র ছিল তাঁর উপাধি। জীব গোস্বামী তাঁকে এ উপাধি প্রদান করেন। তাঁর রচিত একটি বিখ্যাত পদের অংশ বিশেষ-
চল চল কাঁচা অঙ্গের লাবণি
আবনী বাহিয়া যায়।
ঈসত হাসির তরঙ্গ- হিল্লোলে
মদন মুরছা পায়
জীবনী সাহিত্য
জীবনী সাহিত্য মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের একটি বিশিষ্ট অংশ। শ্রীচৈতন্যদেব ও তার কতিপয় শিষ্যের জীবন কাহিনী অবলম্বনে এই জীবনী সাহিত্যের সৃষ্টি। বাংলা ভাষায় প্রথম চৈতন্যদেবের যে জীবনী লেখা হয় তার নাম চৈতন্যভাগবত। যিনি লেখেন তার নাম- বৃন্দাবন দাস। চৈতন্যদেবের জীবনী গ্রন্থকে কড়চা বলা হয়। চৈতন্যদেব এক অক্ষরও কবিতা লেখেননি তবু তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস এ অধিকার করে আছেন বড় একটি স্থান।
অনুবাদ সাহিত্য
মধ্যযুগের বাঙ্গালি মানসের বিবর্তনে অনুবাদ সাহিত্যের ভূমিকা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।
হিন্দু কবিরা অনুবাদ করেছেন তাদের পূরান কাহিনীগুলো; মুসলমান কবিরা অনুবাদ করেছেন ফারসি, আরবি, হিন্দি থেকে রোমাঞ্চকর উপাখ্যান।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস আরো ভালভাবে জানতে হবে। এই সামান্য পরিসরে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সম্পূর্ণভাবে লেখা সম্ভব নয়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস জানতে পাঠ করুন ড. সৌমিত্র শেখরের “বাংলা ভাষা ও সাহিত্য জিজ্ঞাসা” পুস্তকটি। আর হ্যাঁ, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস আমাদের বাঙ্গালিদের জন্য জেনে রাখা আবশ্যক।
উল্লেখযোগ্য কিছু অনুবাদ সাহিত্য ও সাহিত্যিকের নাম-
অনূদিত গ্রন্থ |
অনুবাদকের নাম |
মূল রচয়িতা |
যে ভাষা থেকে অনূদিত |
রামায়ণ |
কৃত্তিবাস ওঝা |
বাল্মীকি |
সংস্কৃক ভাষা |
মহাভারত |
কাশীরাম দাস |
বেদব্যাস |
সংস্কৃক ভাষা |
ইউসুফ-জুলেখা |
শাহ মুহাম্মদ সগীর |
আব্দুর রহমান জামী |
ফারসি ভাষা |
লাইলী-মজনু |
বাহরাম খান |
আব্দুর রহমান জামী |
ফারসি ভাষা |
পদ্নাবতী |
আলাওল |
মালিক মুহাম্মদ জায়সী |
হিন্দি ভাষা |
মধুমালতী |
সৈয়দ হামজা |
মনঝন |
হিন্দি ভাষা |
লোক সাহিত্য
বাংলা সাহিত্য লোকসাহিত্যের ক্ষেত্রে বেশ ধনী। বাংলা লোকসাহিত্যে আছে ছড়া, প্রবাদ, গীতিকা, ধাঁধাঁ, রূপকথা ইত্যাদি। লোকসাহিত্যের প্রাচীনতম সৃষ্টি ছড়া। বাংলা লোকসাহিত্য সংগ্রহের জন্য সবচেয়ে বিখ্যাত চন্দ্রকুমার দে । তিনি ময়মনসিংহের অধিবাসী। তার সংগৃহীত গীতিকাগুলোকে সম্পাদনা করে ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’ (১৯২০) নামে প্রকাশ করেন ড. দীনেশচন্দ্র সেন। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের রূপকথা সংগ্রহের নাম- ঠাকুরমার ঝুলি, ঠাকুরদাদার ঝুলি। উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর রূপকথা সংগ্রহের নাম- টুনটুনির বই। ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’ বিশ্বের ২৩টি ভাষায় মুদ্রিত হয়।
বাংলা লিপি
ভারতীয় সমস্ত লিপিরই আদি জননী ব্রাহ্মীলিপি। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে ব্রাহ্মীলিপি থেকে তিনটি লিপির সৃষ্টি হয়। যথা- পশ্চিমা লিপি, মধ্যভারতীয় লিপি ও পূর্বী লিপি। ভারতের এ পূর্বী লিপির কুটিল রূপ থেকেই বাংলা লিপির উদ্ভব। সম্রাট অশোক তার অধিকাংশ কর্ম ব্রাহ্মী লিপিতে লেখান । ভারতীয় খরোষ্ঠী লিপিমালা ডান দিক থেকে বাম দিকে লেখা হয়। সেন যুগে বাংলা বর্ণ গঠনের কাজ শুরু হয় এবং স্থায়ী রূপ লাভ করে পাঠান যুগে। ইংরেজ কর্মচারী চার্লস উইলকিন্স পঞ্চানন কর্মকারকে লিপি তৈরির কৌশল শেখান। পঞ্চানন কর্মকারের পর তার পুত্র ও পৌত্র মিলে প্রায় পঞ্চাশ বছর সুনিপুণতার সাথে বাংলা লিপি তৈরি করে গেছেন।
যুগ সন্ধির কাল
১৯৬১ থেকে ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কে বলা হয় যুগসন্ধিকাল। মধ্যযুগের শেষ ও আধুনিক যুগের শুরুর এই শত বছরে চলেছে একটি নীরব প্রস্তুতি। এ প্রস্তুতির প্রধান পুরোহিত ছিলেন কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। সেজন্য ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তকে বলা হয় যুগ-সন্ধিক্ষণের কবি।
আধুনিক যুগ
১৮০১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে শুরু হয় বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগ। এ যুগকে দু’টি পর্যায়ে ভাগ করা যায়- ১৮০১ থেকে ১৮১৬ সাল পর্যন্ত প্রথম পর্যায় এবং ১৮৬১ থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত দ্বিতীয় পর্যায়। আধুনিক যুগের প্রথম পর্যায়ে শুরু হয় বাংলা গদ্যের চর্চা । উইলিয়াম কেরির অধিনায়কত্বে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের লেখক গোষ্ঠ্রি বাংলা গদ্যের ধারাবাহিক চর্চা শুরু করেন । প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্য শুধুমাত্র কবিতার মাধ্যমে রচিত হতো। আধুনিককালে কবিতার পাশাপাশি গদ্যেও সাহিত্য রচিত হয়েছে। এ সময় সাহিত্য নিয়েছে নানা মাত্রায় মোড়। উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, ছোটগল্পসহ বহু কিছু সৃষ্টি হয়েছে এ যুগে। উনিশ শতকের সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা বাংলা গদ্যের বিকাশ।
দ্বিতীয় অন্ধকার যুগ
১৭৬০ থেকে ১৮৩০ সাল সময় পর্যন্ত আমাদের সাহিত্যের পতন ঘটেছিল। ১৭৬০ সালে মারা যান মধ্যযুগের শেষ বড় কবি ভারতচন্দ্র রায়। তার সাহিত্যে উৎকৃষ্ট সাহিত্য যেমন ছিল, পতনের পরিচয়ও ছিল। ভারতচন্দ্রের পরে কবিওয়ালারা ও শায়েররা সে পতনকে পূর্ণ করেন। অষ্টাদশ শতকের শেষভাগকে ধরা হয় কবিগানের স্বর্ণযুগ হিসেবে। কবি গান রচয়িতাদের জীবনী সংগ্রহ করেছিলেন কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯ সাল) । কবিওলাদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে প্রাচীন তাঁর নাম গোঁজলা গুঁই । কয়েকজন বিখ্যাত কবিওয়ালার নাম- রাম বসু, রাসু, এন্টনি ফিরিঙ্গি, হরু ঠাকুর, নিধুবাবু, কেষ্টামুচি প্রমুখ। কবিওয়াল এন্টনি ফিরিঙ্গি ছিলেন পর্তুগিজ। টপ্পা গানের জনক ছিলেন নিধুবাবু। তাঁর পুরো নাম রামনিধি গুপ্ত। তাঁর একটি অমর গান আছে-
“নানান দেশের নানান ভাষা,
বিনে স্বদেশী ভাষা,
পুরে কি আশা?”
এ সময় মুসলমান সমাজে দেখা দিয়েছিল শায়েররা। তাদের রচিত সাহিত্যকে বলা হতো পুঁথিসাহিত্য। এসব সাহিত্যকে কেউ কেউ বটলার পুঁথিও বলতেন। এ শ্রেণীর সাহিত্য রচনা করে যারা খ্যাতি লাভ করেছেন, তাদের মধ্যে আছেন ফকির গরীবুল্লাহ, সৈয়দ হামজা, মোহাম্মদ দানেশ প্রমুখ। এদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলেন ফকির গরীবুল্লাহ। কবিওয়ালারা ও শায়েররা মধ্যযুগের শেষ প্রান্তে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
শ্রীরামপুর মিশন ও বাংলা গদ্য
১৮০০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত এ খ্রিস্টান প্রতিষ্ঠানটি বাংলা গদ্যের বিবর্তনে যে ভূমিকা রেখেছিল তা অস্বীকার করার নয়। এ মিশনটির মূল কাজ ছিল এ দেশে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করা। এ কাজ করতে গিয়ে তারা বাইবেল ও আনুষঙ্গিক অনেক গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করেন এবং বাংলা গদ্যের বিবর্তনে ভূমিকা রাখেন। ১৮০৮ সালে শ্রীরামপুর মিশন ডেনিসদের হাত থেকে ইংরেজদের হাতে চলে আসে। মুদ্রণযন্ত্র এবং মুদ্রণ উপযোগী বাংলা অক্ষর তৈরি হয় এখানেই । ‘মথী রচিত মিশন সমাচার’ শ্রীরামপুর মিশন থেকে বাংলায় মুদ্রিত প্রথম গদ্যগ্রন্থ। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে এটি মুদ্রিত হয়।
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ও বাংলা গদ্য
ভারতীয় উপমহাদেশে কর্মরত ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ কর্মচারীদের বাংলাভাষা শিক্ষাদানের জন্য ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে বাংলা বিভাগ চালু হলে অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত হন শ্র্রীরামপুর মিশনের পাদ্রি এবং বাইবেলের অনুবাদক উইলিয়াম কেরি। ১৮০০ সালের সাথেই মূলত: জড়িত হয়ে আছে আধুনিক গদ্যের ইতিহাস । প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ উইলিয়াম কেরির উৎসাহ ও উদ্দিপনায় কলেজের বাংলা বিভাগে তাঁর সহকারীদের রচনার গুণেই বাংলা গদ্য ধীরে ধীরে উন্নয়নের দিকে এগোয়। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থ ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র’ (১৮০১)। এর রচয়িতা রামরাম বসু । এ গ্রন্থটি বাংলায় মুদ্রিত প্রথম মৌলিক গ্রন্থ। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে প্রকাশিত দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘কথোপকথন’ রচয়িতা উইলিয়াম কেরি, রচনাকাল ১৮০১। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে নিযুক্ত পন্ডিতদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গ্রন্থ রচনা করেন মৃতুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার । তার রচিত মোট গ্রন্থ সংখ্যা ৫টি । ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের আরো যারা লেখক ছিলেন তারা হচ্ছেন- গোলকনাথ শর্মা, চণ্ডীচরণ মুনশী, রামকিশোর তর্কালঙ্কার, হরপ্রসাদ রায়, রাজীবলোচন প্রমুখ । ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ চালু ছিল ১৮৫৪ সাল পর্যন্ত।
বাংলা গদ্য ও সাময়িক পত্র
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পর বাংলা গদ্য লাভ করেছে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে । বাংলা ভাষার প্রথম পত্রিকা প্রকাশ করেন শ্রীরামপুরের মিশনারিরা, পত্রিকার নাম ‘দিকদর্শন’ (১৮১৮) । শ্রীরামপুর মিশন থেকে ১৮১৮-তে ‘সমাচার দর্পণ’ নামক একটি সাপ্তহিক পত্রিকা বের হয়। এর সম্পাদক ছিলেন জেসি মার্শম্যান । বাঙালিদের প্রচেষ্টায় যে পত্রিকাটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়েছিল তার নাম ‘বাঙ্গালা গেজেট’ সম্পাদক গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য। ১৮২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘সম্বাদ কৌমুদী’ পত্রিকা, যার সম্পাদক ছিলেন ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় । তৎকালীন সব পত্রিকাকে ছাপিয়ে উঠেছিল ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ‘সম্বাদ প্রভাকর’(১৮৩১) পত্রিকা।
বাংলা গদ্য ও রামমোহন রায়
উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে আবির্ভূত হন রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩)। সর্বপ্রথম বাংলা গদ্যকে অনুবাদ, আলোচনা, বির্তক ও মীমাংসার বাহন হিসেবে গড়ে তুললেন তিনি। রামমোহন রায়ের উল্লেখযোগ্য রচনা- বেদান্ত গ্রন্থ (১৮১৫); বেদান্তসার (১৮১৫); ভট্টাচার্যের সহিত বিচার (১৮১৭); গৌড়ায় ব্যাকরণ (১৮৩৩) ইত্যাদি । তার ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’ বাঙালির লেখা প্রথম বাংলা ব্যাকরণ।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১)
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর শিল্পসম্মত বাংলা গদ্যের জনক। ঈশ্বরচন্দ্রের মূল নাম ছিল ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা। তিনি বিদ্যাসাগর উপাধি পান সংস্কৃত কলেজ থেকে। বিদ্যাসাগরই সবার আগে আবিষ্কার করেন বাংলা গদ্যের ছন্দ। তিনি সবার আগে নিয়মিতভাবে ঠিক জায়গাটিতে ব্যবহার করেন দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন ইত্যাদি চিহৃগুলো। বিদ্যাসাগর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়ন- ‘‘বিদ্যাসাগর সবার আগে বাংলা গদ্যকে মুক্তি দেন সংস্কৃত দীর্ঘ সমাসের কবল থেকে এবং আবিষ্কার করেন বাংলা শব্দের সঙ্গীত ।” বিদ্যাসাগরের অধিকাংশ বই-ই অনুবাদ। তার প্রথম বই ‘বেতালপঞ্চবিংশতি’ (১৮৪৭, হিন্দি থেকে) । বিদ্যাসাগর অনুবাদ করেছিলেন কালিদাসের বিখ্যাত বই ‘শকুন্তলা’ (১৮৫৮), সংস্কৃত থেকে বাল্মীকি ও ভবভূতির কাহিনী চয়ন করে লিখেছিলেন ‘সীতার বনবাস’ (১৮৬০, সংস্কৃত থেকে) । তিনি শেক্সপিয়ারের ‘কমেডি অব এররস’ বাংলায় রূপান্তরিত করেছিলেন ‘ভ্রান্তিবিলাস’ নামে। তার বিখ্যাত কিছু পাঠ্যবই-‘বর্ণ পরিচয়’, ‘কথামালা’, বোধোদয়’ ইত্যাদি । ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ বর্ণ পরিচয় বইয়ের বিখ্যাত লাইন। তার মৌলিক রচনাগুলো হচ্ছে ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ (১৮৫৫), ‘বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার’ (১৮৫৫), ‘অতি অল্প হইল’ (১৮৭৩), আবার অতি অল্প হইল (১৮৭৩), ব্রজবিলাস, (১৮৫৫), ‘প্রভাবতী সম্ভাষণ’ (১৮৬৩), রত্ন পরীক্ষা’’ (১৮৮৬), স্বরচিত জীবনচরিত (১৮৯১) । ‘বিদ্যাসাগর চরিত’ (১৯৯২) । বিদ্যাসাগর রচিত ব্যাকরণ গ্রন্থের নাম ‘ব্যাকরণ কৌমুদী’। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পারিবারিক পদবি বন্দ্যোপাধ্যায় । তিনি নিজে স্বাক্ষর করতেন ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা নামে । তিনি মূলত সমাজ সংস্কারক (বিধবা বিবাহ প্রচলনের জন্য খ্যাত) হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন ।
অক্ষয়কুমার দত্ত
অক্ষয়কুমারদত্ত ছিলেন বাংঙ্গালির মধ্যে বিজ্ঞানমনস্ক লেখক । বাংলা গদ্যকে জ্ঞানচর্চার উপযোগী করে তুলেছিলেন তিনি । ধর্মের নিষ্ফলতা সম্পর্কে লিখেছিলেন একটি বিখ্যাত সমীকরণ । শ্রম + প্রার্থনা= শস্য, শ্রম= শস্য; সুতরাং প্রার্থনা = ০ । শ্রম ছাড়া ধর্মকর্মের ফল শূণ্য । অক্ষয়কুমার ছিলেন সে সময়ের বিখ্যাত ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকার সম্পাদক । তার রচিত পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছিল ‘চারুপাঠ’ । তিনখন্ডে রচিত এই বইটি সেকালের একটি অবশ্য পাঠ্য বই ।
প্যারীচাঁদ মিত্র
বাংলা গদ্যের ভুবনে এক তুমুল বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র । তার ছদ্ননাম ছিল টেকচাঁদ ঠাকুর । তিনি ঘোষণা করেন সাধু গদ্য চলবে না, চলবে না সংস্কৃত শব্দ । তিনি সাহিত্য রচনা শুরু করেন কথ্যরীতিতে । সেই রীতিতে তিনি রচনা করেন ‘আলালের ঘরের দুলাল (১৮৫৮)। বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস এটি। এ উপন্যাসের নায়ক মতিলাল। ঠকচাচা এ উপন্যাসের একটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র।
কালীপ্রসন সিংহ
প্যারীচাদেঁর বিদ্রোহের পথ ধরে বাংলা গদ্যজগতে আগমন করেন আরেক বিপ্লবী লেখক কালীপ্রসন সিংহ (১৮৪০-১৮৭০) । তিনি চলতি গদ্যে ‘হুতাম প্যাঁচার নকশা’ (১৮৬২) নামে একটি অনন্য বই রচনা করেন । তার এ বইটি আলোড়ন জাগিয়েছিল নানা কারণে, এর একটি বড় কারণ এর চলতি গদ্য ।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩)
বাংলা কবিতায় আধুনিকতা আনেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। শুধু কবিতায় নয়, তিনি আধুনিকতা আনেন নাটকে, প্রহসনে । তিনি ইংরেজি ভাষায় লিখেছিলেন দুটি দীর্ঘ কাব্য । একটির নাম ‘ক্যাপটিভ লেডি’ (১৮৪৯), অপরটির নাম ‘ভিশনস অব দি পাস্ট’ । মধুসূদন যে অমরতা কামনা করেছিলেন ইংরেজিকাব্য রচনা করে তা লাভ করা যাবে না বুঝতে পেরে হঠাৎ ফিরে আসেন বাংলা কবিতার ভুবনে ১৮৫৯ অব্দে । কবি মধুসূদন বাংলা কবিতার ভুবনে আসেন ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’ নামে একটি চার সর্গের আখ্যায়িকা কাব্য নিয়ে ।কাব্যটির প্রকাশকাল ১৮৬০। তার প্রধান এবং বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কাব্য ‘মেঘনাদবধ কাব্য’; এটি প্রকাশিত হয় ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে । এ কাব্যে মধুসূদন পয়ার ছন্দকে প্রচলিত আকৃতি থেকে মুক্তি দিয়ে করে তোলেন প্রবাহমান । এটিকে অনেকে বলেন ‘অমিত্রাক্ষর ছন্দ’ । এছাড়া মধুসূদন লিখেছেন ‘ব্রজাঙ্গনা কাব্য’ (১৮৬১), ‘বীরাঙ্গানা কাব্য’ (১৮৬২) এবং ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’ (১৮৬৬) । মধুসূদন সর্বপ্রথম বাংলা ভাষায় সনেট রচনা করেন, যার নাম দিয়েছিলেন ‘চতুর্দশপদী কবিতা’ । ১৮৬০ সালে তিনি প্রথম সনেট লেখার কথা ভাবেন এবং একটি সনেট রচনাও করেন । এটিই পরে পুর্ণলিখিত হয়ে নাম পায় ‘বঙ্গভাষা’ । মধুসূদন সনেট লিখেছিলেন ফ্রান্সের ভার্সাই শহরে বসে । বাংলা সাহিত্যে তার পদচারণা মাত্র ২৭ বছরের মধ্যেই সমাপ্তি লাভ করেছিল ।
রোমান্টিক কবি
রবীন্দ্রনাথের গুরু হিসেবে খ্যাত বিহারীলাল চক্রবর্তী বাংলা কবিতার প্রথম রোমান্টিক কবি । প্রথম খাঁটি আধুনিক কবি ও গীতিকবিতার স্রষ্ঠা তিনি । তার পথ ধরে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ । বিহারীলালকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন বাংলা কাব্যের ‘ভোরের পাখি’ । তার শ্রেষ্ঠ কাব্যের নাম ‘সারদামঙ্গল’ (১৮৭৯)। কবির রচিত দু’টি বিখ্যাত লাইন-
সর্বদাই হু হু করে মন
বিশ্ব যেন মরুর মতন।
অনলাইনে ফ্রি ইনকাম করার সহজ পদ্ধতি জানতে ভিজিট করুন
বাংলা নাটকের সূচনাপর্ব
বাংলায় আধুনিক নাট্য সাহিত্যের সৃষ্টি হয় পাশ্চাত্যের প্রভাবে । মধ্যযুগের দীর্ঘ পরিসরে বাংলা সাহিত্যে শুধু কাব্যই পাওয়া যায়, নাটকের কোন পরিচয় পাওয়া যায়নি । নাটক বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের সৃষ্টি । বাংলা নাটকের পথচলা শুরু হয়েছিল একজন রুশ নাগরিকের হাত ধরে । তার নাম হেরাসিম (জেরাসিম বা গেরাসিম) লেবেদেফ । ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দকে বাংলা নাটক রচনার ইতিহাসের দিক থেকে একটি উল্লেখযোগ্য বছর হিসেবে ধরা যায় । এ বছর পন্ডিত রামনারায়ণ তর্করত্নের রচিত ‘কুলীনকুল সর্বস্ব’, তারাচরণ শিকদার রচিত ‘ভদ্রার্জুন’, নন্দকুমার রায়ের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলাম’, কালিপ্রসন্ন সিংহের ‘বাবু’ নাটক অভিনীত হয় । এর পরেই আবির্ভাব ঘটে আধুনিক নাট্যকার মধুসূদন দত্তের । তাঁর রচিত নাটকগুলো হচ্ছে ‘শর্মিষ্ঠা’ (১৮৫৯), ‘পদ্মাবতী’ (১৮৬০) । এসময় তাঁর রচিত ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ এবং ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ সমকালীন বাংলা সাহিত্যের দু’টো শ্রেষ্ঠ প্রহসন । তাঁর শ্রেষ্ঠ নাটক ‘কৃষ্ণকুমারী’ (১৮৬১)। তারপর আসেন দীনবন্ধু মিত্র । প্রধান এই দু’জনের সাধনার ফলেই বাংলা নাটক প্রাথমিক পর্বের বিভিন্ন রকম দুর্বলতা ও অসঙ্গতি কাটিয়ে উঠে । দীনবন্ধুর শ্রেষ্ঠ নাটক ‘নীলদর্পণ’ (১৮৬০)। তারপর আসেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ, তখনকার সর্বাপেক্ষা খ্যাতিমান নাট্য ব্যক্তিত্ব । জ্যোতিরিন্দ্র নাথ ফরাসি ও সংস্কৃত ভাষার নাটক বাংলায় অনুবাদ করে নাট্যসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটক দেশজ ও ইউরোপীয় নাট্যরীতির সংমিশ্রণের ক্ষেত্রে অতুলনীয় । তিনি প্রতীকী সাংক্ষেতিক নাট্যরীতির উদ্ভব করেন । বাংলার খ্যাতিমান এবং প্রতিষ্ঠিত গদ্যশিল্পী মীর মোশাররফ হোসেনের উল্লেখযোগ্য নাটক হচ্ছে ‘বসন্তকুমারী’ (১৮৭৩) এবং ‘জমিদারদর্পণ’ (১৮৭৩)। বাংলায় যথার্থ ঐতিহাসিক নাটক রচনার ধারা প্রবর্তন করেন দ্বিজেন্দ্রলালরায়। তাঁর শ্রেষ্ঠ নাটক ‘সাজাহান’ (১৯০৯) । নুরুল মোমেনের ‘নেমেসিস’ (১৯৪৮) বাংলাদেশের নাট্যধারার প্রথম জীবনচিত্র ও আঙ্গিক বিবেচনায় সর্বপ্রথম সার্থক নাটক । বাংলাদেশের নাটককে বলা চলে মুনীর চৌধুরীর একক প্রচেষ্টায় আন্তর্জাতিক নাট্য সাহিত্যের সমগোত্রীয় করে তোলেন । ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দেলনকে কেন্দ্র করে তিনি রচনা করেন অসামান্য নাটক ‘কবর’ (১৯৫৩) । সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ রচিত ‘বহিপীর’ ও ‘তরঙ্গ ভঙ্গ’ (১৯৬৪) বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্যে ভিন্নধর্মী সংযোজন । ১৯৭১ সালের পর সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল্লাহ আল মামুন, মামুনুর রশীদ, সেলিম আল দীন, মমতাজউদ্দীন আহমদ- এদের রচিত নাটক বাংলাদেশের নাট্যক্ষেত্রে মূল্যবান সংযোজন।
বাংলা নাটকের যা কিছু প্রথম
বিষয় |
নাটক |
নাট্যকার |
বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম নাটক |
ভদ্রার্জুন |
তারাচরণ শিকদার |
প্রথম বিয়োগাত্মক নাটক |
কীত্তিবিলাস |
যোগেন্দ্র চন্দ্র গুপ্ত |
প্রথম সার্থক ট্রাজেডি নাটক |
কৃষ্ণকুমারী |
মাইকেল মধুসূদন দত্ত |
বাংলা সাহিত্যের প্রথম প্রহসন নাটক |
একেই কি বলে সভ্যতা |
মাইকেল মধুসূদন দত্ত |
বাংলা সাহিত্যের প্রথম সামাজিক নাটক |
কুলীনকুল সর্বস্ব |
রাম নারায়ণ তর্করত্ন |
প্রথম আধুনিক নাটক |
শর্মিষ্ঠা |
মাইকেল মধুসূদন দত্ত |
প্রথম মুসলমান রচিত সার্থক নাটক |
হাড় জ্বালানী |
গোলাম হোসেন |
প্রথম মুসলমান রচিত সার্থক নাটক |
বসন্তকুমারী |
মীর মোশাররফ হোসেন |
বাংলাদেশ বেতারের প্রথম নাটক |
কাঠঠোকরা |
বুদ্ধদেব বসু |
বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রথম নাটক |
একতলা দোতলা |
মুনীর চৌধুরী |
নাট্যব্যক্তিত্ব ও তাঁদের নাটক
১. মাইকেল মধুসূদন দত্ত: শর্মিষ্ঠা, পদ্মাবতী, কৃষ্ণকুমারী, একেই কি বলে সভ্যতা, বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ ।
২. দনিবন্ধু মিত্র: সধবার একাদশী, নীলদর্পণ।
৩. মীর মোশাররফ হোসেন: জমিদার দর্পণ।
৪. গিরিশচন্দ্র ঘোষ: জনা , প্রফুল্ল, সিরাজউদ্দৌলা।
৫. দ্বিজেন্দ্র লাল রায়: নূরজাহান, সাজাহান।
৬. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: ডাকঘর, রাজা, অচলায়তন, বিসর্জন, রক্তকবরী, চিত্রাঙ্গাদা, চিরকুমার সভা।
৭. নুরুল মোমেন: রূপান্তর, নেমেসিস, নয়া খানদান, যদি এমন হতো।
৮. আসকার ইবনে শাইখ: তিতুমীর, রক্তপদ্ম।
৯. মুনীর চৌধুরী: রক্তাক্ত প্রান্তর, মানুষ, কবর।
১০. শাহাদাৎ হোসেন: সরফরাজ খাঁ, মসনদের মোহ, আনার কলি।
১১. সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ: বহিপীর, তরঙ্গভঙ্গ।
১২. শওকত ওসমান: আমলার মামলা, তস্কর ও লস্কর, কাকরমনি।
১৩. জসীম উদ্দীন: পদ্মাপাড়, বেদের মেয়ে, মধুমালা ।
১৪. আলাউদ্দিন আল আজাদ: ইহুদির মেয়ে, মায়াবি প্রহর, মরক্কোর যাদুকর।
১৫. সিকান্দার আবু জাফর: শকুন্তলা উপাখ্যান, সিরাজউদ্দৌলা, মহাকবি আলাওল।
১৬. মমতাজ উদ্দীন আহমেদ: হরিণ চিতা চিল, স্পার্টাকাস বিষয়ক জটিলতা, সাতঘাটের কানাকড়ি।
১৭. আব্দুল্লাহ আল মানুন: সুবচন নির্বাসনে, এখনই সময়, কোকিলারা।
১৮. মামুনুর রশীদ: ওরা কদম আলী, ওরা আছে বলেই, এখানে নোঙর।
১৯. সৈয়দ শামসুল হক: পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, নুরুল দীনের সারাজীবন।
২০. সেলিম আল দীন: কিত্তনখোলা, বনদাহশুল, কেরাম মঙ্গল।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বাঙ্গালিদের প্রাণের ইতিহাস।
সম্ভাব্য প্রশ্নোত্তর
১. বাংলা ভাষার প্রথম কবিতা সংকলন চর্যাপদ। এর মূল নাম চর্যাচর্যবিনিশ্চয়। হরপ্রশাদ শাস্ত্রী ১৯০৭ সালে চর্যাপদ আবিষ্কার করেন এবং তার সম্পাদনায় ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত হয় । চর্যাপদের প্রধান কবি কাহৃপা, একটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত।
২. মধ্যযুগের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। এর রচয়িতা বড়ু চন্ডীদাস। শ্রীবসন্ত রঞ্জন রায় ১৯০৯ সালে এটি আবিষ্কার করেন। বসন্ত রঞ্জন রায়ের উপাধি ‘বিদ্বদ্বল্লভ’।
৩. ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি। তিনি ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যের রচয়িতা। তার অন্যান্য গ্রন্থ সত্যনারায়ণ পাঁচালি, রসমঞ্জুরী।
৪. ১৮৮৬ সালে কোরআন শরিফের প্রথম বাংলা অনুবাদ করেন গিরিসচন্দ্র সেন । তার উপাধি ছিল ‘ভাই’ । বাড়ি নরসিংদী জেলায়।
৫. সতেরো শতকের কবি আলাওল রচনা করেন ‘পদ্নাবতী’ কাব্যগ্রন্থ। পদ্নাবতী কাব্যের নায়ক-নায়িকা রত্নসেন ও পদ্নাবতী।
৬. ‘জয়নবের চৌতিশা’, ‘গোরক্ষ’ বিজয় লিখেছেন- শেখ ফয়জুল্লাহ, ‘জঙ্গনামা’ লিখেছেন হায়াৎ মাহমুদ, ‘নবীবংশ’ লিখেছেন সৈয়দ সুলতান।
৭. ১৮০০ সালে শ্রীরামপুর মিশন ও ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।
৮. রাজা রামমোহন রায় ১৮৩৩ সালে প্রথম বাংলা ব্যাকরণ ‘গৌড়িয় ব্যাকরণ’ রচনা করেন । তার অন্যান্য গ্রন্থ বেদান্ত গ্রন্থ, বেদান্ত সার, প্রবর্তক সম্বাদ ।
৯. ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যের জনক। তিনি প্রথম যতিচিহৃ’র প্রয়োগ করেন । প্রথম মৌলিক গ্রন্থ প্রভাবতী সম্ভাষণ ও প্রথম আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘বিদ্যাসাগর চরিত’ তার লেখা।
১০. বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস ‘আলালের ঘরের দুলাল’ এর রচয়িতা প্যারিচাঁদ মিত্র । এটি প্রথম ১৮৫৭ সালে ‘মাসিক পত্রিকা’ নামক সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়।
১১. বাংলাভাষার প্রথম স্বার্থক উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’। রচয়িতা বষ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যয়। তার অন্যান্য উপন্যাস- কপালকুন্ডলা, মৃণালিনী, রাজসিংহ, সীতারাম ।
১২. বাংলা ভাষার প্রথম দৈনিক পত্রিকা- সংবাদ প্রভাকর।
১৩. বাংলা সাহিত্যের প্রথম ও সার্থক মহাকাব্য ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্য ১৮৬১ সালে প্রকাশিত হয়।
১৪. বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ- কথোপকথন।
১৫. ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থ- নীলদর্পণ।
১৬ বাংলা সাহিত্যের প্রথম স্বার্থক ট্রাজেডি নাটক- কৃষ্ণকুমারী।
১৭. ‘ভাগবত’ কাব্যটি সংস্কৃত ভাষার রচিত হিন্দু ধর্মের পবিত্রগ্রন্থ। মালাধর বসু কাব্যটিকে ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ নামে অনুবাদ করেন। এ জন্য রুকন উদ্দিন বরকত শাহ তাঁকে ‘গুণরাজ খান’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
১৮. কায়কোবাদের মহাকাব্য ‘মহাশ্মশান’। এর উপজীব্য বিষয় পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ।
১৯. বাংলা সনেটের জনক মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত কাব্য: তিলোত্তমা সম্ভব কাব্য, বীরঙ্গা কাব্য, নাটক- শর্মিষ্ঠা,
পদ্নাবতী, কৃষ্ণকুমারী । প্রহসন- একেই কি বলে সভ্যতা, গদ্য- হেস্টর বধ, গীতি কবিতা- আত্মবিলাপ।
২০. সঙ্গীত শতক, বঙ্গসুন্দরী, নিসর্গ সুদর্শন, সারদামঙ্গল, সাধের আসন, লিখেছেন বিহারী লাল চক্রবর্তী।
২১. দীনবন্ধু মিত্র লিখেছেন- নীলদর্পণ নাটক, প্রহসন- বিয়ে পাগল বুড়ো, সধবার একাদশী, জামাই বারিক।
২২. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম: ২৫ বৈশাখ ১২৫৬, ৭ মে ১৮৬১, মৃত্যু: ২২ শ্রাবণ ১৩৪৮, ৭ আগস্ট ১৯৪১। তার রচিত প্রথম কাব্য- ‘বনফুল’ (১৮৭৬); প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস-‘বউ ঠাকুরানীর হাট’ (১৮৮৩), ‘গোরা’ রাজনৈতিক উপন্যাস, গল্প- ‘দেনা-পাওনা’ এটি বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ছোট গল্প।
২৩. শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত উপন্যাস- শ্রীকান্ত, চরিত্রহীন, গৃহদাহ, পল্লীসমাজ, দেবদাস, দত্তা, শুভদা, শেষ প্রশ্ন, দেনাপাওনা, শেষের পরিচয়, ছোটগল্প- মন্দির, মামলার ফল, মহেশ।
২৪. বেগম রোকেয়া লিখেছেন- মতিচুর, সুলতানার স্বপ্ন, পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী এবং কামিনী রায় লিখেছেন- আলো ও ছায়া, মাল্য ও নির্মাল্য, আলোক সঙ্গীত, দীপ ও ধাপ।
২৫. কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম: ২৫ মে ১৮৯৯, ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬, মৃত্যু: ২৯ আগস্ট ১৯৪৬, ১২ ভাদ্র ১৩৮৩। তার প্রথম উপন্যাস ‘বাঁধনহারা’ (১৯২৭), কাব্য- ‘অগ্নিবীণা’ (১৯২২), নাটক- ‘ঝিলিমিলি’, কবিতা- ‘মুক্তি’, গল্প-‘হেনা’, প্রবন্ধ- ‘তুর্কী মহিলার ঘোমটা খোলা’।
২৬. জীবনানন্দ দাশের উপন্যাস- মাল্যদান, সতীর্থ। কাব্যগ্রন্থ- ঝরা পালক, ধূসর পান্ডুলিপি, মহাপৃথিবী, সাতটি তারার তিমির, বনলতা সেন, বেলা-অবেলা, কালবেলা। প্রবন্ধ- কবিতার কথা।
২৭. পথের পাঁচালী (১৯২৯), অপরাজিত, আরণ্যক, লিখেছেন- বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
২৮. কর্ণফুলি, তেইশ নম্বর তৈলচিত্র, লিখেছেন- আলাউদ্দিন আল-আজাদ। ঘর-মন জানালা, লিখেছেন- দিলারা হাশেম। নোঙ্গর, লিখেছেন- আবু রুশদ। পিঙ্গল আকাশ, লিখেছেন- শওকত আলী।
২৯. লোক লোকান্তর, কালের কলস, সোনালী কাবিন, মায়াবী পর্দা দুলে উঠে, লিখেছেন- আল মাহমুদ।
৩০. রাত্রি শেষ, ছায়া হরিণ, আশায় বসতি, দু’হাতে দুই আদিম পাথর, লিখেছেন- আহসান হাবিব
৩১. মঙ্গল কাব্যের অপ্রধান শাখা: ২টি । ক. ধর্মমঙ্গল কাব্য, খ শিবমঙ্গল কাব্য/কালিকামঙ্গল কাব্য। মঙ্গল কাব্যের প্রথম কবি- ময়ূর ভট্ট। তাঁর রচিত কাব্যের নাম- ‘হাকন্দপুরাণ’।
৩২. কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দরের আদি কবি- কবি কষ্ক । তাঁর রচিত লোকগাঁথার নাম- ‘কষ্ক ও লিলা’। রাম প্রসাদ সেন কালিকামঙ্গলের বিশিষ্ট কবি। তাঁর কাব্য গ্রন্থের নাম- ‘কবিরঞ্জন’।
৩৩. দৌলত উজির বাহরাম খান ষোড়শ শতকের বিখ্যাত কবি। তাঁর উপাধি ‘দৌলত উজির’ । চট্টগ্রামের নৃপতি নেজাম শাহ সুর তাকেঁ এ উপাধি দেন। তাঁর বাড়ি চট্টগ্রাম। ‘লাইলী-মজনু’ কাব্যটি তিনি অনুবাদ করেন। আব্দুর রহমান জামী রচিত ‘লায়লা ওয়া মজনুন’ কাব্য থেকে তিনি এটি অনুবাদ করেন।
৩৪. স্বর্ণকুমারী দেবী বাংলা সাহিত্যের প্রথম বাঙ্গালি মহিলা কবি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ ভগিনী তিনি। তিনি দীর্ঘকাল বিখ্যাত সাহিত্য পত্রিকা ভারতী’র সম্পাদিকা ছিলেন।
৩৫. মুহাম্মদ কবির ষোড়শ শতকের কবি ছিলেন । ‘মধুমালতী’ কাব্যটি অনুবাদ করেন। হিন্দি ভাষার কবি মনঝন রচিত কাব্য অবলম্বনে তিনি এটি অনুবাদ করেন। সৈয়দ হামজা অষ্টাদশ শতকের কবি। পুঁতি সাহিত্যের প্রাচীনতম কবি তিনি। ‘মধুমালতী’ কাব্যটি তিনিও অনুবাদ করেন।
৩৬. শাহ মুহাম্মদ সগীর মধ্যযুগের প্রথম মুসলিম কবি। ‘ইউসুফ-জুলেখা’ তাঁর রচিত অনুবাদ কাব্য । ‘ইউসুফ-জুলেখা’ কাব্যের অন্যান্য রচয়িতাগণ হলেন- আব্দুল হাকিম, ফকির গরীবুল্লাহ, গোলাম সাফাতউল্লাহ, সাদেক আলী ফকির।
৩৭. ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ হল দীনেশচন্দ্র সেনের রচিত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচনার প্রথম পূর্ণাঙ্গ প্রয়াস।
৩৮. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় রচনা করেন ‘Origin and Development of Language’ গ্রন্থটি (১৯২১ সাল)
৩৯. ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ রচিত গ্রন্থের মধ্যে ‘ভাষা ও সাহিত্য’’ (১৯৩১ সাল), ‘বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত’ (১৯৫৯ সাল), ‘বাংলা সাহিত্যের কথা’ (১৯৬৩ সাল) ইত্যাদি গ্রন্থগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
৪০. ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতার জন্য কাজী নজরুল ইসলাম ১ বছর কারারুদ্ধ হয়েছিলেন । এটি প্রকাশিত হয় ‘ধূমকেতু’র শারদীয় সংখ্যায়।
৪১. বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত রচনা করেছেন- ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ।
৪২. শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’ উপন্যাসটি সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হয়েছিল।
৪৩. ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’ এই প্রার্থনা করেছেন- ঈশ্বরী পাটনী।
৪৪. ‘সতী ময়না’ ও ‘লোরচন্দ্রনী’ কাব্য দু’টির রচয়িতা- দৌলত কাজী ।
৪৫. ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’ ও ‘মহুয়া পালা’র রচয়িতা- দ্বিজ কানাই ।
৪৬. আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারির রচয়িতা- আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী ।
৪৭. ‘মোস্তফা চরিত’ গ্রন্থের রচয়িতা- মাওলানা আকরাম খাঁ।
৪৮. ‘চাচা কাহিনী’র লেখক- সৈয়দ মুজতবা আলী ।
৪৯. ‘বাঙালির ইতিহাস’ গ্রন্থটি লিখেছেন- নীহার রঞ্জন রায় ।
৫০. ‘লালসালু’ গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ- Tree without roots.
৫১. ‘হুতোম প্যাচার নকশা’ প্রহসনে কালী প্রসন্ন সিংহ ব্যঙ্গ করেছেন- কলকাতার বাবু সমাজের ।
৫২. বিদ্রোহী কবিতাটি প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক ‘বিজলী’ পত্রিকায় ।
৫৩. ‘বাঁধনহারা’ একটি পত্রোপন্যা । এটি ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
৫৪. ‘অগ্নিবীনা’ নিষিদ্ধ হয় ‘রক্তাম্বর ধারিণী মা’ কবিতার জন্য ।
৫৫. ‘কবর’ কবিতা- কল্লোল পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ।
৫৬. ফররুখ আহমেদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ-‘সাতসাগরের মাঝি’।
৫৭. ‘আবোল তাবোল’- লিখেছেন সুকুমার রায়।
৫৮. ‘পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ’- কথাটি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ।
৫৯. ‘নদী ও নারী’ লিখেছেন- হুমায়ন কবির। মোজাম্মেল হক রচিত উপন্যাস- জোহরা ।
৬০. নবাব ফয়জু্ন্নেসা চৌধুরানীর আত্মজীবনীমূলক বই- রূপজালাল।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বাঙ্গালিদের প্রাণের ইতিহাস।
শ্রেষ্ঠ ১০ কাব্যগ্রন্থ
কবি |
কাব্যগ্রন্থ |
মাইকেল মধুসূদন দত্ত |
মেঘনাদ বধ কাব্য (১৮৬১) |
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর |
সোনারতরী |
কাজী নজরুল ইমলাম |
অগ্নীবীণা |
জসীম উদ্দীন |
নকশি কাঁথার মাঠ (১৯২৯) |
জীবনানন্দ দাস |
বনলতা সেন (১৯৪২) |
বুদ্ধদেব বসু |
বন্দীর বন্দনা (১৯৩০) |
বিষ্ণ দে |
স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত |
শামসুর রহমান |
বিধ্বস্ত নীলিমা |
আল মাহমুদ |
সোনালি কাবিন |
ফররুখ আহমেদ |
সাত সাগরের মাঝি (১৯৪৪) |
শ্রেষ্ঠ ১০ ঔপন্যাসিক ও উপন্যাস
ঔপন্যাসিক |
উপন্যাস |
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর |
গোরা (১৯২৯) |
বঙ্কীমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় |
কপালকুন্ডলা (১৮৬৬) |
মানিক বন্দোপাধ্যায় |
পদ্মানদীর মাঝি(১৯৩৬) |
তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় |
কবি |
বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় |
পথের পাঁচালী (১৯২৯) |
সতীনাথ ভাদুড়ি |
ঢোঁড়াই চরিত মানস |
অদ্বৈত মল্ল বর্মন |
তিতাস একটি নদীর নাম |
সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ |
লালসালু (১৯৪৮) |
অমীয় ভূষণ মজুমদার |
গড় শ্রী খন্ড |
দেবেশ রায় |
তিস্তাপাড়ের বৃত্তান্ত |
সাহিত্যিকদের নাম ও উপাধি |
সাহিত্যকদের প্রকৃত নাম ও ছদ্ননাম |
||
নাম |
উপাধি |
ছদ্মনাম |
প্রকুত নাম |
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর |
বিশ্বকবি/নাইট |
ভানুসিংহ |
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর |
কাজী নজরুল ইসলাম |
বিদ্রোহী কবি |
বীরবল |
প্রথম চৌধুরী |
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত |
ছন্দের যাদুকর |
বনফুল |
ডঃ বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় |
বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় |
সাহিত্য সম্রাট |
নীল লোহিত |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় |
শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় |
অপরাজেয় কথাশিল্পী |
সুনন্দ |
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় |
বিহারীলাল চক্রবর্তী |
ভোরের পাখি |
বানভট্ট |
নীহাররজ্ঞন ণ্ডপ্ত |
ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর |
গদ্যের জনক |
মৌমাছি |
বিমল ঘোষ |
ভারত চন্দ্র |
রায়গুণাকর |
জরাসন্ধ |
চারুচন্দ্র চক্রবর্তী |
হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় |
বাংলার মিল্টন |
হুতুম পেঁচা |
কালি প্রসন্ন সিংহ |
ঈশ্বর চন্দ্র ণ্ডপ্ত |
যুগসন্ধিকালের কবি |
গাজী মিয়া |
মীর মোশাররফ হোসেন |
গোবিন্দ চন্দ্র দাস |
স্বভাব কবি |
শওকত ওসমান |
শেখ আজিজুর রহমান |
মুকুন্দ দাস |
চারণ কবি |
কায়কোবাদ |
কাজেম আল কুরায়শী |
গোলাম মোস্তফা |
কাব্য সুধাকর |
কালকূট |
সমরেশ বসু |
জীবনান্দ দাশ |
রূপসী বাংলার কবি |
নীহারিকা দেবী |
অচিন্ত্য কুমার সেনণ্ডপ্ত |
শামসুর রহমান |
কবি শ্রেষ্ঠ |
পরশুরাম |
রাজশেখর বসু |
ফররুখ আহমেদ |
মুসলিম রেঁনেসার কবি |
টেকচাঁদ ঠাকুর |
প্যারিচাঁদ মিত্র |
মালাধর বসু |
গুনরাজ খান |
পরশুরাম |
রাজশেখর বসু |
সমর সেন |
নাগরিক কবি |
হায়াৎ মাহমুদ |
ড. মনিরুজ্জামান |
সুকান্ত ভট্টোচার্য |
কিশোর কবি |
বড়ু চণ্ডীদাস |
মধুসূদন মজুমদার |
যতীন্দ্রনাথ বাগচি |
দু:খবাদের কবি |
অবধুত |
অনন্ত বড়ু |
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত |
ক্লাসিক কবি |
জরাসন্ধ |
কালিকানন্দ |
দীনবন্ধু মিত্র |
রায় বাহাদুর |
হায়াৎ মাহমুদ |
চারুচন্দ্র মুখোপাধ্যায় |
বিনয়কৃষ্ণ মিত্র |
যাযাবর |
মোহিত লাল মজুমদার |
সত্যসুন্দর দাস |
এছাড়া বাংলা সাহিত্যে আর যা যা পড়তে হবে তাহলো- বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিকদের জীবনী, বাংলা সাহিত্যে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকা, পত্রিকার প্রকাশকাল ইত্যাদি। তাছাড়া কবি-সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম, উপাধি, বিখ্যাত পংক্তি ও উক্তিসমূহ।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বাঙ্গালিদের প্রাণের ইতিহাস।
Voice Change শেখার সহজ টেকনিক জানতে ভিজিট করুন
সম্পাদনায়
মো: নজরুল ইসলাম
০১৭১৬-৩৮৬৯৫৮